চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে কোয়ারেনটাইন সুবিধা থাকছে না!
৩ আগস্ট ২০২০ ০৯:৫১
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) চিকিৎসাসেবা দেওয়া হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য হোটেলে অবস্থান করে কোয়ারেনটাইনের যে সুবিধা দেওয়া হচ্ছিল, তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তবে যারা চলতি রোস্টারে বিভিন্ন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন, তারা এই সিদ্ধান্তের আওতায় আসবেন না। সে হিসাবে সপ্তাহ দুয়েক পর এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, হোটেলের পরিবর্তে আলাদাভাবে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাছাড়া যারা বাড়িতে কোয়ারেনটাইন পিরিয়ড পার করতে পারবেন, তাদের জন্যও বিশেষ ভাতা দেওয়া হতে পারে বলে পরিকল্পনা চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সোমবার (৩ আগস্ট) এ বিষয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
রোববার (২ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ছাড়াও মহাপরিালক এবং স্বাস্থ্য সচিবের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে কোয়ারেনটাইন সুবিধা প্রত্যাহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে মূলত কোভিড ডেডিকেটেড মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রওশন আনোয়ারের এক অফিস আদেশের সূত্র ধরে। ২ আগস্ট জারি করা ওই আদেশে বলা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী হাসপাতালের যারা হোটেলে অবস্থান করতে ইচ্ছুক, তাদের নিজ খরচে অবস্থান করতে হবে।
এ আদেশ জারি হওয়ার পর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ক্ষোভ ও আশঙ্কার কথা জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির চলতি রোস্টারে দায়িত্ব পালন করা একজন চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের এই সপ্তাহের রোস্টারের দায়িত্ব শেষ হবে আগামীকাল (সোমবার)। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফোন করে জানিয়েছে, হোটেলে কোয়ারেনটাইন করা যাবে না। হোটেল কর্তৃপক্ষও ফোন করে জানিয়েছে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। বাসায় বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন। এ অবস্থায় বাসায় কিভাবে কোয়ারেনটাইনে থাকব, বুঝতে পারছি না।
মুগদা হাসপাতালের আরও বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। তারা সবাইই বাসায় কোয়ারেনটাইন পালনের বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। মুগদা হাসপাতালের এমন নির্দেশনা নিয়ে খোঁজখবর করতেই জানা যায়, সব কোভিড হাসপাতালের জন্যই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের হোটেলে কোয়ারেনটাইন সুবিধা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ উদ্দিন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। তবে চলতি রোস্টারে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের ক্ষেত্রে আরও ১৫ দিন পরে মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে রাজধানীতে আলাদাভাবে ছয়টি স্থানে থাকার বিষয়ে আমাদের সচিব একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে তারা থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রে বিআরটিসি বাসে যাতায়াতের সুবিধা দেওয়া হবে। যেখানে বিআরটিসির সেবা নেই, সেখানে সরকারি খরচে বিকল্প কিছু চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
ডা. ফরিদ বলেন, ‘এরই মধ্যে সচিব যে চিঠি দিয়েছেন, তা আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকেও সবাইকে জানানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি কেউ বাসায় থেকে সঙ্গনিরোধ অবস্থায় থাকতে পারেন, তবে তাদের জন্যও আলাদাভাবে আর্থিক সুবিধা বরাদ্দ করা হয়েছে।’ মুগদা হাসপাতালের পরিচালক পুরো বিষয়টি না জেনেই হয়তো নির্দেশনা দিয়েছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। হয়তো মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক নির্দেশনাটি পুরোপুরি খেয়াল করে দেখেননি।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল বিষয়ে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখছি, আসলে কী হয়েছে। এখন যারা রোস্টারে আছেন, তাদের বিষয়ে আগামীকাল আলোচনা হবে। যারা এরই মধ্যে নতুন রোস্টার শুরু করছেন, তাদের বিষয়েও আগামীকাল সিদ্ধান্ত হবে। যাদের বাড়িতে আইসোলেশন সুবিধা নেই, তাদের জন্য আমরা কিছু স্থানের কথা ভাবছি, যা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোতে কিভাবে তাদের শিফট করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবব। আগামীকাল (সোমবার) এসব বিষয়ে নিয়ে আরও আলোচনা হবে।
স্বাস্থ্য সচিব বলেন, বর্তমানে দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অনেক চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে গিয়ে। এটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিষয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা সিরিয়াসলি ভাবছি। তাদের পাশে সরকার আছে। আমরা কারও অসুবিধা করে কিছুই করব না।
আবদুল মান্নান আরও বলেন, বর্তমানে যদি কেউ কোথাও থাকে, তবে তার সুবিধার দিকটি তো বিবেচনায় নিতেই হবে। সেক্ষেত্রে তাকে সেই হোটেল থেকে শাহবাগের প্রশাসন অ্যাকাডেমিতে শিফট করার জন্য কী কী সাহায্য করা প্রয়োজন, সেটাও করব। এগুলো তো আমাদের করতেই হবে। একমাস পরে হোক আর দুই মাস পরে হোক, কোনো না কোনো সময় এটা করতেই হবে। যে প্রজ্ঞাপন আমরা দিয়েছি, তা অনেক দিন ধরে যাচাই-বাছাই করেই করা হয়েছে।
এর আগে, ২৯ জুলাই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নানের সই করা ওই পরিপত্রে জানানো হয়, কোভিড-১৯ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সরকারি চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সাধারণভাবে একাধারে ১৫ দিনের বেশি দায়িত্ব পালন করবেন না। প্রতি মাসে ১৫ দিন দায়িত্ব পালন শেষে পরবর্তী ১৫ দিন তারা সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেনটাইন) ছুটিতে থাকবেন। চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ১৫ দিন কর্মকালীন পৃথক অবস্থানের জন্য বিশেষ ভাতা ও খাবারসহ আবাসনের সুবিধা পাবেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঢাকা মহানগরের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ১৫ দিন কর্মকালীন পৃথক অবস্থানের জন্য-বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস একাডেমি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যানেজমেন্ট (বিয়াম), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট (নায়েম), টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটে অবস্থান করতে পারবেন। আর ঢাকা মহানগরের বাইরে সব জেলা ও উপজেলার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করা হবে।
এছাড়াও চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের যাতায়াতের জন্য বিআরটিসির যানবাহন ব্যবহারের বিষয়ে বলা হয়েছে পরিপত্রে। যেখানে বিআরটিসির যানবাহন নেই, সেখানে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রিকুইজিশন করা অথবা ভাড়ায় যানবাহনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যুক্ত ঢাকা মহানগরীর চিকিৎসকরা দৈনিক দুই হাজার ও ঢাকার বাইরের চিকিৎসকেরা এক হাজার ৮০০ টাকা করে ভাতা পাবেন। এছাড়া ঢাকার নার্সরা এক হাজার ২০০ ও ঢাকার বাইরের নার্সরা এক হাজার এবং ঢাকার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা ৮০০ ও ঢাকার বাইরের ৬৫০ টাকা করে দৈনিক ভাতা পাবেন। কেউ এক মাসে ১৫ দিনের বেশি ভাতা পাবেন না।
এর আগে, ১২ এপ্রিল রাজধানীতে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ২০টি হোটেল নির্ধারণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তখন থেকেই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা এই সুবিধা পেয়ে আসছেন।
কোভিড-১৯ চিকিৎসক নভেল করোনাভাইরাস স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বাস্থ্যকর্মী