আশিতে পা অনুপম সেনের, স্বপ্ন একটি মানুষের রাষ্ট্রের
৫ আগস্ট ২০২০ ২২:০৪
চট্টগ্রাম ব্যুরো: আশিতে পা রাখলেন ড. অনুপম সেন। ষাটের দশকে যৌবনে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। এখনো সেই শিক্ষকতাকেই আঁকড়ে আছেন। উত্তাল যৌবনে লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির জন্য মানবিক, বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যারা, তাদের সামনের কাতারের একজন এই শিক্ষাবিদ।
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ— তিনটি রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখেছেন। মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। সেই লড়াই এখনো থামেনি, এখনো মানুষের মর্যাদা আর অধিকারের জন্য উচ্চকণ্ঠ তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশেও মানুষের প্রাপ্য মর্যাদা না পাওয়ার কষ্ট তাকে নিয়ত পোড়ায়। স্বপ্ন দেখেন, এই রাষ্ট্র একদিন মানুষের হবে।
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই মনীষীর ৭৯তম জন্মদিন আজ (বুধবার, ৫ আগস্ট)। দিনভর অগণতি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীর শুভেচ্ছা জানানোর ফাঁকে কথা বলেছেন সারাবাংলা’র সঙ্গে।
অনুপম সেন বলেন, ‘আমি তিনটি রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখেছি। জন্মেছিলাম ব্রিটিশ আমলে। বেড়ে উঠেছি পাকিস্তান আমলে। এখন আমি এই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। স্বাধীন বাংলাদেশ মানে সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন সুলতানি আমল ছিল, নবাবি আমল ছিল, কিন্তু সেগুলো প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ব্যবস্থা ছিল না। কারণ সেখানে মানুষের মর্যাদাটা সেভাবে ছিল না।’
‘ফরাসীরা ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই থেকে স্বাধীনতা উদযাপন শুরু করে। ফরাসি বিপ্লবের পরে যখন নতুন সংবিধান হলো, সেই সংবিধানে তারা মানুষের মর্যাদার কথা লিপিবদ্ধ করল। তখন থেকেই তারা স্বাধীনতা উদযাপন শুরু করে। ১৭৮৯ সালের ৪ আগস্ট তারা নতুন সংবিধান তৈরি করে সেখানে মানুষের অধিকারের কথা ঘোষণা করল,’— বলেন অনুপম।
একইভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রকৃত স্বাধীনতা পেল মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমরা বাংলা ভাষায় লেখা বাঙালির প্রথম সংবিধান পেলাম, যে সংবিধানে জনগণের কথা বলা হলো। অর্থাৎ মানুষ তার মৌলিক অধিকার আর মর্যাদার একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা পেল, যেটা তার প্রকৃত স্বাধীনতা। এই রাষ্ট্র জনগণের হলো সেই সংবিধানের মধ্য দিয়ে।’
‘বঙ্গবন্ধু এই কথা বারবার উপলব্ধি করেছিলেন। উনার আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যাবে— ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট যখন ক্ষমতা পেল, তখনই কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকবে না। কারণ এখানে জনগণের কোনো ক্ষমতা নেই। শাসকের ক্ষমতা দিয়ে তো মানুষের রাষ্ট্র হবে না। জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করলে তো সেই রাষ্ট্র জনগণের হবে না। মূলত বঙ্গবন্ধুর যে সংগ্রাম, সেটা ছিল মানুষের রাষ্ট্র গড়ার সংগ্রাম।’
স্বাধীনতার পর দেশ অনেক এগোলেও মানুষ এখনো তার মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা পুরোপুরি পাচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন অনুপম সেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এই রাষ্ট্র অনেক এগিয়েছে। দারিদ্র্য অনেক কমেছে। পাকিস্তান আমলে আমরা ক্ষুধায় কাতর, খাদ্যঘাটতির একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখেছি। ১৯৭১ সালে এ দেশে এক কোটি মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন হতো। এখন চার কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে, চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকছে।’
‘কিন্তু সেটাই শেষ নয়। যেতে হবে আরও বহুদূর। একটি রাষ্ট্রে একজন নাগরিক তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আশ্রয়, কর্মসংস্থান, সংস্কৃতি, অবকাশ, চিন্তার স্বাধীনতা— এই অধিকারগুলো যতক্ষণ পুরোপুরি পাবে না, ততক্ষণ তাকে পুরোপুরি স্বাধীন মানুষ বলা যাবে না। প্রতিটি মানুষ মানুষের মর্যাদা পাবে, অর্থাৎ রাষ্ট্রটা মানুষের রাষ্ট্র হবে— এটাই প্রকৃত স্বাধীনতা,’— মত ড. অনুপমের।
স্বাধীন রাষ্ট্রে মানুষের মর্যাদা পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ার আক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই এই বাংলাদেশ একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির দেশ হবে। কয়েকজনের হাতে পুঞ্জিভূত সম্পদ আর সবাই সম্পদবিহীন হয়ে বেঁচে থাকবে— এটা তো মানুষের রাষ্ট্রের উদাহরণ নয়। আমি চাই, বাংলাদেশ মানুষের রাষ্ট্র হোক।’
১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর আইস ফ্যাক্টরি রোডে জন্ম নেন অনুপম সেন। গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে হলেও জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে চট্টগ্রাম শহরেই। ১৯৬৫ সাল থেকে ৫৫ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় থাকা ড. অনুপম সেন এখন বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভালোবাসায় কাটলো জন্মদিন
জন্মদিনে কর্মস্থল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য শিক্ষাবিদ সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম তফজল হক, রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মোহাম্মদ ইব্রাহিম, গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইফতেখার মনির, স্থপতি মো. শহিদুল হক ও ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান কাউছার আলম। এরপর উপাচার্য ড. অনুপম সেন জন্মদিনের কেক কাটেন।
সমবেতদের উদ্দেশে উপাচার্য অনুপম সেন অনুভূতি তুলে ধরেন এভাবে, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। কিন্তু প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি পরিবার আমার জন্মতারিখ মনে রেখেছে এবং পালন করছে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির এই ভালোবাসায় আমি অভিভূত ও আনন্দিত। এই ইউনিভার্সিটি একদিন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে এবং তারা সেই চেষ্টা করেও যাচ্ছেন।’