হারিয়ে যাচ্ছে ঘটকালি, পেশা বদলাচ্ছেন ঘটক
৭ আগস্ট ২০২০ ০৮:২৫
মেহেরপুর: জেলার গাংনীর মিনাপাড়া গ্রামের ইমান আলী। ছোটবেলায় বন্ধুর বিয়ে দেন পাশের গ্রামের এক অনাথ মেয়ের সাথে। সে সময় গ্রামের মৌলবির মুখে শুনেছিলেন ১০১টি বিয়ে দিলে জান্নাতি হওয়া যায়। এ থেকেই শুরু করেছিলেন ঘটকালি। গত ২২ বছরে দশ হাজারেরও বেশি ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। সবাই তাকে ‘ইমান ঘটক’ নামে চিনলেও এখন আর হাঁকডাক নেই। বিয়ের ক্ষেত্রে ঘটকের আর তেমন প্রয়োজন পড়ছে না। তাই বিলুপ্তির পথে এ ঘটকালি প্রথা, পেশাও বদলে নিয়েছেন অনেক ঘটক।
বছর বিশেক আগেও গ্রাম-গঞ্জে চোখে পড়তো ঘটকরা পান চিবাতে চিবাতে ছাতা বগলে হেঁটে চলেছেন গ্রামের পর গ্রাম। সজাগ দৃষ্টি কার বাড়িতে রয়েছে বিবাহযোগ্য ছেলে বা মেয়ে। ঘটকের কাছে টাকা-পয়সা তেমন মুখ্য নয় বরং বিয়ের ঘটকালি করে তিনি অনেক আনন্দ পান। তবে বিয়ে সুখের হলে ঘটকের কথা কেউ তেমন মনে রাখে না আর বিয়ের পর যদি অশান্তি বা ঝামেলা দেখা দেয় তাহলে সব দোষ গিয়ে পড়ে ঘটকের ঘাড়ে।
রাইপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, ঘটকদের কথা চালাচালির ধরনই আলাদা। সাতশ’ সাত বার কথা চালাচালি না হলে নাকি বিয়ে হয় না। অর্থাৎ সামাজিক বিয়েতে কথা খরচ করতে হয় প্রচুর। ঘটকের প্রধান কাজই হচ্ছে মেয়ের বাড়িতে ছেলে এবং ছেলের পরিবারের বংশ গৌরব ও গুণ-গরিমা প্রকাশ করা, আর ছেলের বাড়িতে মেয়ের রূপসৌন্দর্য ও শিক্ষা-দীক্ষা তুলে ধরা। এভাবেই তিনি দু’টি পরিবারকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলেন। ঘটকের মাধ্যমে পছন্দের পর্বটি শেষ হলে বিয়ের কথাবার্তা ও চূড়ান্ত হয় বিয়ের দিনক্ষণ। বিয়ের আগের দিন হয় গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান।
বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ ভোজনপর্ব শেষ হলে শুরু হয় বিয়ের মূলপর্ব। কাজি এসে বিয়ে রেজিস্ট্রির কাজটি সমাধা করেন। বিয়ে হয়ে গেলে চলে কনে বিদায়ের পালা। বরের বাড়িতে বধূবরণসহ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অন্দরমহলে অর্থাৎ সাজানো বাসরঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় বর-কনের দাম্পত্য জীবন। এরপরই আসে ঘটক বিদায়ের পালা। ছেলে বা মেয়ের পক্ষ থেকে তিনি পান কিছু নগদ টাকা, কখনও সঙ্গে জামাকাপড় ও একটা ছাতা।
গাংনী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম জানান, আদিকাল থেকেই এ ঘটকালি প্রথাটি চালু। আগে গ্রাম-গঞ্জে পেশাদারি ঘটক প্রথা ছিল না। তারা টাকা-পয়সা নিয়েও কোনো চিন্তা করতো না। ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকে এ প্রথাটি ব্যাপকতা পায়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতেও ঘটকের বিজ্ঞাপন দেখা দেয়। এতে খরচ খরচাটাও বেশি। বর্তমানে কেউ আর বেশি খরচ করতেও চাচ্ছে না, আবার নিজেরাই এ ঘটকালির কাজ করছেন।
রুয়েরকান্দি গ্রামের ঘটক আব্দুর রশিদ জানান, গত ১৫ বছরে তিনি ১৭০৩টি বিয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ১৫টি। ঘটকের প্রচলন না থাকায় এখন ঘটকালি ছেড়ে দিয়ে তিনি ইজিবাইক চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আগে ঘটক ছাড়া বিয়ে কল্পনা করা যেতো না। আর এখন ছেলে-মেয়েরা এমনকি বিধবারাও ঘর পালিয়ে বিয়ে করছে। তাছাড়া এখন ছেলে-মেয়ে আর তাদের পরিবারের লোকজন নিজেরাই বিয়ের দেখাশোনা পর্বটি সেরে ফেলায় আর ঘটকের প্রয়োজন পড়ছে না। আগে ঘটকের আগমনে বিয়ে বাড়িতে নানা গীত গাইতো। যা বিভিন্ন নাটকেও দেখা যায়। এখন আর যেমন বিয়ে নেই পারিবারিকভাবে, তেমন এ ঘটকালি প্রথাটির প্রচলনও হারাতে বসেছে।’