‘করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতা নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ পেয়েছে’
৮ আগস্ট ২০২০ ২২:০৫
ঢাকা: বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে ভঙ্গুরতা, দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা তা করোনাকালে নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশ পেযেছে। গত ছয়/সাত বছর ধরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমরা যেসব বক্তব্য দিয়ে আসছিলাম সরকারিভাবে তা গ্রহণ করা হয়নি। বরং তা অত্যান্ত নেতিবাচক ভাবে নেওয়া হয়েছে। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হবো আর জিডিপির মাত্র এক শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহার করব, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এর ফল নিদারুণভাবে জাতি ভোগ করছে।
শনিবার (৮ আগস্ট) ‘আমরা কেমন আছি’ শীর্ষক সমসাময়িক বিষয় নিয়ে সারাবাংলাডটনেটের সরাসরি আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ ভার্চুয়াল সংলাপে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সারাবাংলার বিশেষ প্রতিনিধি এমএকে জিলানী।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য বলেন, ‘আমরা দৃশ্যমান বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প করেছি। কিন্তু এই অবকাঠামোকে ব্যবহার করার জন্য দেশ ও জাতির যে স্বাস্থ্য দরকার, নারী ও শিশুর যে স্বাস্থ্য দরকার, প্রবীণের যে সুরক্ষা দরকার তা আমরা নিশ্চিত করতে পারেনি। আবার স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি‘র এক শতাংশ বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিলো সেগুলো ছিল অতিমূল্যায়িত। অর্থাৎ ১০ টাকার জিনিস ১০০ টাকায় কিনেছে, কখনওবা হাজার টাকায়। আমরা বরাদ্দ করেছি এক শতাংশ কিন্তু বাস্তবে অর্ধ শতাংশ হয়তো মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এটা একটা বড় সমস্যা ‘
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘বাংলাদেশে যেভাবে কোভিড মোকাবিলা করেছে, আমরা তার চেয়ে আরও ভালোভাবে পারতাম। প্রথমত, আমরা শুরুতে এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি। মার্চ মাসের ৮ তারিখে যখন কোভিড সংক্রামণের ঘটনা দেখা গেলো তখন অনেকে বলেছেন, আমাদের মতো দেশে এটা থাকবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, অমরা বীরের জাতি, এটা আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না। এগুলো একেবারেই অপ্রসাঙ্গিক কথা ছিল। এরপর আমরা দেখেছি যে, বেশি পরিমাণ পরীক্ষা করা হলে সংক্রমণের বিষয় জানা যেত, সেটাও তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। তারপর চিকিৎসার ক্ষেত্রে অমরা যে সমন্বয়ের আশা করেছিলাম সেটাও আমরা পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘কোডিভ সংক্রামণের চেয়ে কম পীড়াদায়ক নয়- এমন কিছু ঘটনা কোভিডের সময় ঘটেছে। আমরা দেখলাম একটা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বড়ধরনের দুর্নীতি হলো। করোনায় ভুয়া জাল সার্টিফিকেট দেওয়া হলো। এতে আমরা দেশে যে বিপন্ন হলাম তা নয়, এর মাধ্যমে বিদেশেও আমাদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হলো। আমাদের বিমানের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেলো। মনে রাখতে হবে, আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে মানুষ অনেক বেশি বিপন্ন থাকে। পরবর্তীতে দেখা গেলো, শুধু স্বাস্থ্য না স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট আরও ১০ রকমের সমস্যা আছে। সেই সমস্যাগুলোর কারণে আমরা আরও বেশি বিপন্ন হয়েছি।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যখাতের একটা বড় নীতিগত জায়গা ছিল কমিউনিটি ক্লিনিক। কিন্তু করোনাকালে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক কাজ করেনি বা কাজে লাগানো যায়নি। এমনকি জেলা-উপজেলাগুলোতে যে হাসপাতাল রয়েছে সেগুলোও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে ব্যবহার করা যায়নি। সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউ ও ভেন্টিলেশন থাকার কথা- সেগুলোর কিছুই নেই। এগুলো অনেকটা উদ্ভটভাবে আমাদের কাছে প্রকাশ পেয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় দুচিন্তার মধ্যে পড়লাম তখন- যখন দেখলাম, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণের যে ক্ষমতা, সে ক্ষমতার ভেতরে বড়ধরনের দুর্নীতি ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সাধারণ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং হেলথ টেনেশিয়ানরা যারা আছেন তারা এই অব্যবস্থাপনার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। করোনাকালে সময়মতো তাদের প্রয়োজনীয় পিপিই দিতে পারিনি। অনেক ক্ষেত্রে মানহীন জিনিসপত্র দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে আমরা অনেকগুলো ডাক্তারকে হারালাম, অনেক সেবিকাকে হারালাম। কাজেই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে নতুন করে ভাবার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সবাইকে একত্র করে এই খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নতুনভাবে গড়ে তোলা দরকার। সেজন্য সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় করে নতুনভাবে আমাদের দাঁড়াতে হবে। এটা আমাদের করোনার শিক্ষা।’
স্বাস্থ্যখাতের সাররিনা, আরিফুল ও সাহেদদের দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতিতে যাদের নাম এসেছে সেগুলো কেবল উপসর্গ মাত্র। এরা রোগ না, এরা উপসর্গ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই মানুষগুলো কীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলো, কীভাবে এত বড় ব্যাভিচার হলো- সে ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিতে হবে। আর তা করতে না পারলে আবার নতুন নতুন দুর্নীতিবাজের নাম আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো কি শুধু আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় যে স্থায়ী কমিটি- এখনও তারা কোনো কথা বলেনি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিডিয়ার সামনে স্বাস্থ্য খাতের এই অবস্থার জন্য কেন মুখোমুখি হলো না। ডাক্তার হিসাবে যারা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন তাদের নিয়ে কি অন্যান্য চিকিৎসকরা কি বলেছেন, এই দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আমরা নেই। মন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসসদীয় স্থায়ী কমিটি, স্বাস্থ্য খাতের প্রশাসনিক কাজে জড়িত ডাক্তাররা এই অনিয়মের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে মুখ খুলছেন না। আমি অবাক হলাম।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে প্রশাসন আছে, আইন ও বিধিমালা রয়েছে, সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন দেখতে হয়- হাসপাতাল নিয়মিত সেবা দিচ্ছে কি না? হাসপাতালের ওষুধের মেয়াদ আছে কি না? ডাক্তাররা আসলে ডাক্তার কি না? হাসপাতালের লাইসেন্স আছে কি না? এগুলো দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। কিন্তু যাদের দায়িত্ব ছিল, তারাই এই অনিয়ম-দুর্নীতির অংশ হয়ে গেছেন।’
আমরা কেমন আছি ড. দেবপ্রিয় ভট্টচার্য ভার্চুয়াল সংলাপ সম্মানীয় ফেলো সারাবাংলা ফোকাস সিপিডি