Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বঙ্গমাতা মানুষ দেখেই মানুষের ক্যারেক্টার বুঝতে পারতেন’


৯ আগস্ট ২০২০ ০৯:১৯

ঢাকা: বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব খুব তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন মহিয়সী নারী ছিলেন। তার সিক্সথ সেন্স (ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়) অসম্ভব ছিল। তিনি মানুষ দেখে বলতে পারতেন ক্যারেক্টার কী হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসন আমু।

শনিবার (৮ আগস্ট) রাতে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আয়োজিত হয় ‘গৃহকোণ থেকে জনগণের হৃদয়ে’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনার আলোচনায় তিনি এ সব কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

সুভাষ সিংহ রায়ের সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও কবি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত।

করোনা সংকট পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমাদের দেশে বিশেষ করে বাঙালি সমাজে বা মধ্যবিত্ত পরিবারের পিছুটান সবচেয়ে বেশি থাকে এবং পিছুটানটা আছে পরিবারগত দিক থেকে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতিটা করেছেন, সেখানে যদি তার পিছুটান থাকত তাহলে এই রাজনীতি করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।’

আমু বলেন, ‘আমি মনে করি, বেগম মুজিবের ভিতরে কিছু ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকতে পারে। আমরা যদি একটু লক্ষ করি, যে বয়সে ছেলেমেয়েরা সাধারণত বায়না ধরে, বাপ-মার কাছে, মুরব্বিদের কাছে সেই বয়সটা কৈশোরের বয়স। সেই সময় বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় যেতেন লেখাপড়ার জন্য বেগম মুজিব তখন কেবল শিশু থেকে কৈশোর। তখন তিনি বায়না না ধরে বরং তিনি তার জমানো টাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতেন খরচের জন্য। বড় হওয়ার পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার যে অবদান সেটা হল পরের কথা।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে তিনি সবসময় নিজের জমানো টাকা দিয়ে দিতেন, তার হাত খরচের জন্য। এই যে ত্যাগ, যখন তার বয়স হয়ত আট নয় বা দশ বা এগার বছর। সেই থেকেই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি তার ত্যাগের প্রতি যে মহিমা; এটা অনুকরণীয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনে সবচেয়ে বড় আর্শীবাদ স্বরূপ হিসেবে মনে করি, বেগম মুজিব তার সহধর্মিনী হওয়া। তিনি সহধর্মিনী হতে পেরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু এমনিভাবে রাজনীতি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’

আলোচকদের আলোচনার সূত্র ধরে আমু বলেন, ‘কীভাবে বঙ্গবন্ধু তাকে স্বাীকার করে নিয়েছেন কীভাবে তাকে মূল্যায়ন করতেন, এটা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় বঙ্গবন্ধুর লেখনির মধ্য দিয়েই। এই মূল্যায়নটা যে সঠিক ছিল, এটা আজকে আমাদের কাছে প্রতীয়মান। আমরা যারা ছাত্ররাজনীতি করতাম। আমরা তার সান্নিধ্যই বেশি পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি আমাদের সাহস যুগিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, আর্থিক সহযোগিতাও করেছেন। ঈদের টাকাও কিন্তু আমাদের দিয়ে দিচ্ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি করার জন্য, ছাত্র আন্দোলন করার জন্য। আমার মনে আছে, তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতেন গোপনে। যখন সরকারের বেশি কড়াকড়ি থাকত। তার দুটি বাসা নির্ধারিত ছিল। দুইটি বাসা আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। একটি ছিল ইসরাইল হক সাহেব তিনি থাকতেন ধানমন্ডিতে (যুগ্মসচিব)। আরেকজন ছিল তার ছোট ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন সাহেব। এই দুই বাসায় তিনি সাধারণত আমাদের সঙ্গে বেশি কড়াকড়ি হলে দেখা করতেন এবং পরামর্শ দিতেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাগুলো দিতেন। আমাদের কী করণীয় সেইভাবে পরামর্শ দিতেন এবং সহযোগিতা দিতেন। তিনি নিজের হাত খরচের দিকে না তাকিয়ে, পরিবারের খরচের দিকে না তাকিয়ে তার জমানো টাকা অকাতরে দিতেন আমাদের কাজ করার জন্য।’

ছয় দফার পক্ষে সমর্থন রাখার জন্য, পক্ষে বোঝবার জন্য জেলায় জেলায় আমাদের পাঠিয়েছিলেন উল্লেখ করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবদ আমু।

তিনি বলেন, ‘বেগম মুজিব একজন খুব তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন মহিয়সী নারী ছিলেন। তার সিক্স সেন্সড (ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়) অসম্ভব ছিল। তিনি মানুষ দেখে বলতে পারতেন ক্যারেক্টার কী হবে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অনেকের সম্পর্কে বলেছেন। বঙ্গবন্ধু হয়ত তার ডিফার করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে তিনি যাদের ব্যাপারে সাবধান করেছিলেন পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে বেগম মুজিব যেটা বলেছেন সেটাই সঠিক। বঙ্গবন্ধুর ধারণাটা ঠিক ছিল না এবং পরবর্তীকালে সেটার তিনি প্রমাণ পেয়েছিলেন।’

আমু বলেন, ‘আমাদের দেশে তখনকার দিনেও রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিদেশে লেখাপড়া করা তো দূরের কথা বরং পরে দেখতে পাই যখন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এই দেশের পল্লী গ্রামের মায়েরা একমাত্র ছেলেকে রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন যুদ্ধ করতে, তখন কিন্তু বঙ্গমাতাও দ্বিধা করেননি তার দুই সন্তানকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাতে। তিনি বাধা দেননি। একদিকে বঙ্গবন্ধু ফাঁসি কাস্টের আসামি অন্যদিকে তার দুই সন্তানকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন রণক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য। এটা আমাদের দেশে কতজন রাজনীতিবিদের পক্ষে সম্ভব। আজকে কোন রাজনীতিবিদ তো দূরের কথা, কোন বাপ-মায়ের’ই পক্ষে সম্ভব, এটা একবার ভেবেচিন্তে দেখা উচিত?’

এই পরিবারে ত্যাগের মহিমাটা কতখানি ছিল এই পরিবার জাতির জন্য ত্যাগ স্বীকারে কতখানি উদ্বুদ্ধ ছিল। শুধু বঙ্গবন্ধু যে হাসিমুখে কারাবরণ করেছেন, ফাঁসিকাস্টে আসামি হয়েছেন শুধু তাই নয় তার গোটা পরিবারেই আত্মদান করবার যে প্রস্তুত ছিল আজকে এই জিনিসটা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় এবং এটা আমরা অনুধাবন করতে পারি।’

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি প্রসঙ্গ তুলে আমির হোসেন আমু বলেন, ‘প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সময় কিন্তু আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ছিল। সেখানে তাকে (বঙ্গমাতা) স্বাগত জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্যারোলে মুক্তিটা বরণ করে নিয়েছিল, গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বঙ্গমাতা, একা তিনি বাঁধ সাধলেন।’

তিনি বললেন, ‘এটা হতে পারে না। তার সাথে যে আরও ৩৪ জন সহকর্মী আছে তাদেরসহ নিঃশর্তভাবে তিনি বীরের মতো বের হবেন। প্যারোলে শেখ মুজিবের মুক্তি হতে পারে না এবং বঙ্গবন্ধু তার কথা শুনেছিলেন বলেই অল্প কয়েকদিনের ভেতরে তিনি তার অন্য ৩৪ জন সহকর্মীসহ নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেছিলেন।’

৭ মার্চের ভাষণের প্রসঙ্গ তুলে নেপথ্যে বঙ্গমাতার অবদানের কথা স্মরণ করে আমু বলেন, ‘সেই ভাষণ দেয়ার আগে দুইদিন পর্যন্ত, যদিও ওইদিন বঙ্গবন্ধুর জ্বর ছিল কেউ তেমন তার সাথে দেখা করতে পারেনি। তারপর কেউ কেউ চিরকুট লিখে, কেউ কেউ পয়েন্ট লিখে পাঠাতেন। ওনি শুধু একটি কথা বলেছেন, তুমি সারাজীবন যে লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছো, তুমি জানো, তুমি কি চাও? সুতরাং তুমি যা চাও তোমার মন যেটা বলছে, সেই কথাটাই বলবো, কে কি বলবো, না বললো, কোন কথা শোনার দরকার নাই, কান দেয়ার দরকার নাই তুমি তোমার কথা বলবে। তুমি যা চিন্তা করো, তুমি যা ভাবছো, তুমি যা এতদিন সাধনা করেছো, সেই কথাই তোমার পরিষ্কারভাবে বলতে হবে। এটাই ছিল সেদিন তার বঙ্গবন্ধুর প্রতি পরামর্শ। যে বক্তব্য আজকে সারা বিশ্ব দরবারে শ্রেষ্ঠ বক্তব্য হিসাবে পরিগণিত হয়েছে।’

বঙ্গমাতার গুণাবলি দেশবাসীকে অনুধাবন করার আহ্বান জানিয়ে আমু বলেন, ‘আজকে আমাদের দেশে বড় বড় লোকেরা যে দুদকের আসামি হয়, ব্যাংক ঋণ খেলাপি হয়, আজকে আমাদের দেশের তরুণরা যে বিপথগামী হয়, এর অধিকাংশ যদি লক্ষ করে দেখবো, পারিবারিকভাবে কিছুটা আছে, পরিবারের চাওয়া পাওয়ার বিষয় আছে। তাই আজকে তাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত বঙ্গবন্ধু পরিবার থেকে। বঙ্গমাতার কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। কীভাবে ত্যাগ স্বীকার করলে একটি সংসার শুধু নয়, একটি দেশ উপকৃত হয়, একটি জাতি উপকৃত হয়, একটি জাতি স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়।

আমি মনে করি বঙ্গবন্ধু এই দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছেন তার পিছনে বেগম মুজিবের যে ত্যাগ তিতীক্ষা, তার যে ধৈর্য্য, তার যে সহনশীলতা, তার যে সহমর্মিতা, এইসব মিলিয়েই বঙ্গবন্ধু অনুপ্রাণিত হয়েছেন।’

তার মধ্য দিয়েই তিনি উজ্জীবিত উদ্দীপনা কাজে লাগিয়েছিলেন সাংগঠনিক কর্মদক্ষতার মধ্য দিয়ে এবং তিনি তার আজীবনের যে সাধনা সেই সাধনা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই এই দেশের নারী সমাজের তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত বলেও উল্লেখ করেন আমির হোসেন আমু।

আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো বঙ্গমাতাকে দেখার, বাবার সঙ্গে ৩২ নাম্বার বাড়ি গিয়েছিলাম একবার। তাকে দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম, এত বড় একজন মানুষের স্ত্রী এত সাধারণ হবে আমার ধারণাই ছিল না। পরবর্তীতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে বঙ্গমাতাকে নিয়ে আমার জানার আরও সুযোগ হয়- তার মধ্যে আদর্শ ছিল, মানবতা ছিল, দেশপ্রেম ছিল বলেই বঙ্গবন্ধুর চলার পথে কখনও বাধা হননি। বরং তিনি হয়েছেন চলার পথের শক্তি, হয়েছেন প্রেরণা।’

সাংবাদিক অজয় দাস গুপ্ত মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনার আলোচনায় বঙ্গমাতা মুজিব সম্পর্কে নানা জানা-অজানা কথা তুলে ধরেন। তিনি তার প্রবন্ধে, বঙ্গমাতাকে একজন শান্ত ধীরস্থির ধৈর্যশীল সাহসী প্রজ্ঞাবান তেজস্বিনী এবং অমায়িক হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ও কবি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘পৃথিবীতে কিছু মহিয়সী নারী আছেন যারা একজন মহামানবকে তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন আমাদের বঙ্গমাতা বেগম মুজিব তাদের মধ্য একজন। বঙ্গবন্ধুর যে তিন খণ্ড আত্মজীবনী বের হয়েছে সেগুলো লিখতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য ড. নাসরীন আহমদ বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশি ছিলাম, দুই বাড়ির মাঝে ছোট একটা দেয়াল, একটা ছোট গেইট। সেই গেইট দিয়ে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। তাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন থেকে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের অবাধ যাতায়াত ছিল, আর এসব সামলাতেন বঙ্গমাতা শেখ মুজিব। আমরা তাকে কখনও কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি, দেখিনি তাকে উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে।’

নিজের বিয়ের সময় হলুদের অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার উপস্থিতি ও আনন্দময় পরিবেশ তৈরি হয় সে নিয়েও স্মৃতিচারন করেন তিনি।

অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ এবং অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে।

আওয়ামী লীগ টপ নিউজ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গমাতা শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর