প্রবৃদ্ধির তথাকথিত সূচককে আমরা ঈশ্বর বানিয়েছি: দেবপ্রিয়
৯ আগস্ট ২০২০ ০৯:৩৯
ঢাকা: একটিমাত্র প্রবৃদ্ধির তথাকথিত সূচককে আমরা এমনভাবে ঈশ্বর বানিয়েছি, এই ঈশ্বরকে আমরা জনগণ কিন্তু আর ঈশ্বর মানলাম না। এখন কী হলো, এই ঈশ্বর যখন অমাদের ওপর নারাজ হয়ে গেছে, তখন দেখি আমাদের এই মানুষগুলো আগের চেয়ে গরিব হয়ে যাচ্ছে। এখন দেশে এক থেকে দুই কোটি মানুষ কেবল কর্মসংস্থান হারিয়েছে তা নয়, নতুন করে আরও ২০ শতাংশ মানুষ গরিব হয়ে পড়ছেন।
শনিবার (৮ আগস্ট) সারাবাংলা ডটনেটের সরাসরি আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’-এর ভার্চুয়াল সংলাপে অংশ নিয়ে ‘আমরা কেমন আছি’ শীর্ষক সমসাময়িক বিষয়ের আলোচনায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সারাবাংলার বিশেষ প্রতিনিধি এম এ কে জিলানী।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা যে প্রবৃদ্ধির কথা বলি, আমাদের পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন, ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এখন ধোপে টেকে না। এই প্রবৃদ্ধির অর্থগুলো গেল কোথায়? কার কাছে গেল? এই অর্থগুলো কতিপয় মানুষের কাছে গেল। এই প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কেন তারা ট্যাক্সের টাকা দিতে পারল না? বাংলাদেশে গত ১০ বছরে ট্যাক্সের হার বাড়েনি। ট্যাক্সের প্রবৃদ্ধি এখনো জিডিপির ১০ শতাংশ রয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির টাকা গেছে সুইচ ব্যাংকে। এই টাকা রাখার পরেও তারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দেয়নি। তার মানে হলো একটি লোকই কিন্তু অনেকগুলো চরিত্র নিয়ে আমাদের দেশে বিরাজ করছেন। যিনি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি, তিনিই ট্যাক্স দেন না, তিনিই ব্যাংকের টাকা নিয়ে ঋণ খেলাপি হয়েছেন, টাকা ফেরত দেননি, তিনিই দেশের টাকা পাচার করেন। শুধু তাই নয়, তিনি আবার নিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন ভাতাও দিচ্ছেন কি না তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যেটুকু করেন, সেটুকু আবার প্রতারণা করেন। এই রকম একটি গোষ্ঠীকে নিয়েই আমরা প্রবৃদ্ধির কথা বলছি।’
সিপিডির সম্মানিত ফেলো আরও বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির দুর্বলতার বড় কারণ হলো, সরকার গত সময়কালে কোনো ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। ব্যাংকখাতে কোনো সংস্কার হয়নি। পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট করে নেওয়া হয়েছে, সেখানেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাদের কোনো সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কর আদায়, টাকা পাচার, পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার এবং দেশে বড় বড় প্রকল্পগুলো হচ্ছে সেগুলোর প্রকৃত মূল্যে কোনো কিছুতেই সেভাবে নজরদারির মধ্যে আনা হয়নি।’
ড. দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশের গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল সামষ্টিক অর্থনীতি। শুধু প্রবৃদ্ধিকে আঁকড়ে ধরে সরকার যে উন্নয়নের বর্ণনা দেন, এটাকে সঠিক উন্নয়নের ব্যাখা হিসেবে আমি গ্রহণ করি না। এই সময়ে বাংলাদেশে ভোগের দারিদ্র বেড়েছে, ভোগের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে, সম্পদের বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষগুলোর দেশের আয়ের ভেতরে তার নিয়ন্ত্রণ অনেক কমে গেছে। ধনী মানুষগুলোর সম্পদ আরও বেড়েছে। পৃথিবীতে বুকে আমরা একটা পুঁজি ঘাটতির দেশ হলেও পুঁজি রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি। পৃথিবীতে দ্রুততম ধনী হওয়ার দেশ, দ্রুততম হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে।’
দেবপ্রিয় বলেন, ‘দেশে যখন দুঃসময় এল, গত পাঁচ মাসে আমাদের বিত্তদশালীরা মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। আগে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে লাইন দিয়ে টাকা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নানান সুবিধা নিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দেওয়ার লোকের সংখ্যা কমে গেছে। গত পাঁচ বছরে আমাদের সমাজের বিত্তশালীরা যেভাবে লাইন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টাকা দিতেন, এখন সেই অবস্থা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোভিডের আগের ছয় মাস যদি দেখা হয়, তাহল একমাত্র রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক ছিল নেতিবাচক। কর আহরণের হার কম ছিল, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হারও কম ছিল। আমাদের রফতানি প্রবৃদ্ধি কমেছে, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমেছে, আগের বছরের তুলনায় বৈদেশিক সাহায্য কমেছিল। ফলে কোভিডের আগের আট নয় মাসের দুর্বল অর্থনীতির মধ্যেই কোভিড এসেছে। এটি মরার ওপর খড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছে। ফলে কোভিডের কারণে আমাদের অর্থনীতির সমস্যা হয়েছে এটি মোটেও সঠিক না।’
তিনি বলেন, ‘এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্যের জায়গা ছিল, দেশে নতুন একটা মধ্যবিত্ত সমাজ সৃষ্টি হচ্ছিল, এটা হলো বাংলাদেশে একটা শক্তির জায়গা। যারা নিজেরা উদোক্তা হয়ে কাজ করছেন। যারা নতুন প্রযুক্তিতে নিয়ে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই ধারায় বর্তমানে একটা বড় ধাক্কা খেল। সেই ধাক্কাকে সামাল দেওয়ার জন্য সরকার তাদের পাশে দাঁড়াল না। তাদের পিছনে একটা সামাজিক সুরক্ষার কোনো দেয়াল সৃষ্টি করে দেওয়া হলো না। তাদের জন্য কিছু করা হলো না। এটাই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করবে।’
তিনি বলেন, ‘যখন প্রবৃদ্ধি ছিল, তখন আমরা অসাম্যকে মেনে নিয়েছি। আমরা ভেবেছি, কোনোদিন হয়তো আমরাও প্রবৃদ্ধির সুফল পাব। কিন্তু প্রবৃদ্ধি যখন পড়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে যখন অসাম্য বেড়ে যাবে, তখন সামাজিক শান্তি রক্ষা করা জটিল হয়ে পড়বে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রীয় কাঠোমোর চেয়ে শক্তিশালী না হলেও অনেক সময় তারা রাষ্ট্র কাঠামোকে কুক্ষিগত করে ফেলে। যাকে বলা হয় স্টেট ক্যাপচার, মানে রাষ্ট্রটাকেই কেউ যখন দখল করে ফেলে। এর সমাধান হলো রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও ক্রিয়াশীল গণতন্ত্র, আজকে যদি ক্রিয়াশীল গণতন্ত্র থাকত, আমার সংসদ কার্যকর থাকত, তাহলে সংসদে রাজনৈতিক নেতাদের কণ্ঠস্বর থাকত। বর্তমানে সেটি নেই। কথা বলার সুযোগ না থাকায় এটি হচ্ছে।’