মাসে খরচ ১৫ লাখ, ১০ মাসে ‘আদায় হয়নি’ পিপলস লিজিংয়ের ১ টাকাও
৯ আগস্ট ২০২০ ১১:৫৭
ঢাকা: পিপলস লিজিংয়ের আমানতের টাকা উদ্ধারে প্রতি মাসে খরচ হচ্ছে ১৫ লাখ টাকারও বেশি। গত অক্টোবর থেকে টাকা উদ্ধারে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ লাখ টাকা খরচ হলেও আমানতকারীদের অভিযোগ সর্বশেষ ১০ মাসে কোনো টাকা উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সময়ে বিভিন্ন খরচ বাবদ আমানতের টাকা উদ্ধারে কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলসের ১৫/১৬ কোটি টাকা উদ্ধারের দাবি করলেও আমানতকারীরা তা নাকচ করছেন। তাদের অভিযোগ, পিপলস অবসায়নের সময় ১৫ কোটি টাকা কোম্পানির ক্যাশে ছিল, ওটাকেই বাংলাদেশ বাংক উদ্ধার দেখাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৬ জুন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফসিএল) অবসায়ন করা হয়। এতে করে প্রতিষ্ঠানটিতে ছয় হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানককারী এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতাকারীর ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা আটকে পড়েছে। এ টাকার পুরোটাই পিপলস ঋণ হিসাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে। যার একটা বড় অংশ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা নামে বেনামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। পিপলসের আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হলেই কেবল আমানতকারীরা তাদের অর্থ ফেরত পাবেন। কিন্তু পিপলস লিজিং অবসায়নের ১৩ মাস পার হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে বাস্তবে কোনো টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কবে উদ্ধার করা যাবে কিংবা আদৌ যাবে কিনা তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে পিপলস লিজিংয়ের একজন আমানতকারী সামিয়া বিনতে মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিপলসে ব্যক্তি শ্রেণির ছয় হাজার আমানতকারীর ৭১২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই টাকা পিপলস লিজিংকে ঋণ দিয়ে ব্যক্তিশ্রেণির আমানতকারীর টাকা পরিশোধে সহায়তা করতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে ঋণের টাকা পিপলসের সম্পদ বিক্রি করে আদায় করে নিলে সমস্যার কিছুটা হলে সমাধান হতো। ব্যক্তিশ্রেণির আমানতকারীরা গত ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়কে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গভর্নর তা আমলে নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘পিপলসের সম্পদের মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর গ্রিনরোডে সাড়ে তিন বিঘা জমি, মতিঝিলের প্যারামাউন্ট টাওয়ারে দুইটি ফ্লোর এবং চট্টগ্রামের হোটেল রেডিশন ব্লুতেও পিপলসের অংশীদারিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে গ্রিনরোডের জমির মূল্য সাড়ে চারশ কোটি টাকা, ফ্লোর দুইটির মূল্য শত কোটি টাকা। এগুলো বিক্রি করলেও ক্ষুদ্র আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে আন্তরিক না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে পিপলস লিজিংয়ের টাকা লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক আমজাদ হোসেন পিপলসের প্রশাসক হিসেবে অফিস করাকালীন পিপলসে টাকা রাখতে আমাদের উৎসাহিত করেছেন। তার উৎসাহে অনেকেই টাকা রেখেছেন।’
সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, ‘পিপলসের আমানতকারীদের টাকা বর্তমানেও বিভিন্নভাবে অপচয় হচ্ছে। অডিট ও মামলা পরিচালনা, অফিস ভাড়া এবং চা নাস্তা খাওয়ার নামে প্রতি মাসে ১৪/১৫ লাখ খরচ হচ্ছে। এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে টাকা খরচ হলেও কোনো উদ্ধার নেই। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর সঙ্গে আমনতকারীরা যখন সাক্ষাৎ করেছেন তখনই গভর্নর মহোদয় আমাদের জানিযেছেন ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে। ১০ মাস পরেও বলা হচ্ছে ১৫ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে! এটি কীভাবে সম্ভব?’
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহা-ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও পিপলসের অবসায়ক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পিপলসের টাকা উদ্ধারের জন্য একটি অফিস পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানে ২০ জন স্টাফ রয়েছে। এর অফিস ভাড়া ৫ লাখ টাকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন ৫/৬ লাখ টাকা। এ ছাড়াও আইনজীবী খরচ, অডিট খরচ, অফিস পরিচালনা ব্যয় এবং অনান্য খরচসহ গত অক্টোবর থেকে প্রতিমাসে গড়ে ১২/১৩ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পিপলসের মোট ১৫/১৬ কোটি টাকা অবসায়নের পর উদ্ধার করা হয়েছে। করোনার কারণে বর্তমানে টাকা উদ্ধার করা যাচ্ছে না। তবে সরকারের উদ্যোগে ৩০ কোটি টাকার মতো একটি বড় লোন উদ্ধার করার প্রক্রিয়া চলছে।’
তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে হলে আগে পিপলসের পাওনা টাকা উদ্ধার করতে হবে।’
৫ কোটি টাকা কি পিপলসের ক্যাশে ছিল? ক্যাশে না থাকলে এটি কবে আদায় হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘পিপলসের ক্যাশে নয় এই ১৫ কোটি টাকা আমরা অদায় করেছি। পিপলস অবসায়নের পর এটি বিভিন্ন ধাপে আদায় করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৩০ কোটি টাকা আদায়ের প্রক্রিয়া চলছে, এটি আদায় হওয়ার আগে বিস্তারিত বলা যাবে না।’
পিপলস লিজিংয়ে প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি শ্রেণির বিনিয়োগকারীর পাওনা: পিপলস লিজিংয়ের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি শ্রেনীর বিনিয়োগকারীদের আটকে রয়েছে ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা।এর মধ্যে ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৪২১ কোটি টাকা, ৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ও বেসরকারি ব্যাংকের ৪১০ কোটি টাকা আমানত আটকে পড়েছ। এছাড়াও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পিপলস লিজিংয়ের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পাবে। অন্যদিকে ৬ হাজার ব্যক্তি শ্রেণীর আমানতকারীর ৭১২ কোটি টাকা আমানত আটকে পড়েছে।
পিপলসের সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা : ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ছয়মাস পিপলস লিজিং নিরীক্ষা করে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। নিরীক্ষাকালে ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার বছরের আয় ব্যয়, সম্পদ ও দায়দেনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে গত ১০ মার্চ আদালতে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়াও গত ১২ মার্চ ২০০৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিপলসের দায়িত্বে থাকা ৩৮ জনে পরিচালকদের একটি তালিকা আদালত জমা দেয়া হয়েছে।সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিপলসের কাছে বিভিন্ন গ্রাহকদের পাওনার পরিমাণ ১ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা।বিপরীতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পিপলস লিজিংয়ের পাওনা ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা।
পিপলসের বর্তমান সম্পদ: পিপলস লিজিংয়ের অ্যাসেট বলতে রয়েছে রাজধানীর পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডে প্যারামাউন্ট হাইটসে মোট ১৪ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের ২টি ফ্লোর, কয়েকটি গাড়ি এবং নগদ ১৫ কোটি টাকা। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে পিপলসের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট হলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণ দেয়া বাবদ পাওনা ১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। এই ঋণ তাদের মূল অ্যাসেট।
উল্লেখ্য ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে অনুমোদন পাওয়ার পর ২০০৫ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে ছিল।২০১৯ সালে ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়ে পিপলসের অবসায়নের আবেদন করে।গত ২৬ জুন অর্থমন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করলে ১০ জুলাই অবসানের বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তারপর ১১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং থেকে টাকা উত্তোলনে বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং ১৪ জুলাই বাংলাদেক ব্যাংকের ডিজিএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খানকে অবসায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়।