হত্যার পর লাশ ফেলা হয় খালে, ৯ বছর পর গ্রেফতার অন্যতম আসামি
১১ আগস্ট ২০২০ ১২:৪২
ঢাকা: ঘটনার ৯ বছর পর সুজন (২৪) খুনে জড়িত অন্যতম আসামি ফয়জুল ওরফে ফজলুকে (৪২) গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) সকালে সারাবাংলাকে তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন পিবিআইয়ের ঢাকা উত্তর ইউনিটের ইনচার্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. ওসমান গনি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গত রাত ২টার দিকে মুগদার জান্নাতবাগ এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে তাকে আমরা গ্রেফতার করি। গ্রেফতারের পর ফয়জুল ওরফে ফজলু হত্যাকাণ্ডের সব কথা স্বীকার করেছে।’
এএসপি ওসমান গনি জানান, ২০১১ সালের ১৪ মার্চ সুজন (২৬) নামে এক যুবককে হত্যা করে খালে ফেলে লাশ গুম করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ দিন পর খালে অর্ধগলিত অবস্থায় লাশ ভেসে উঠলে সেটি পুলিশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে প্রেরণ করে। সেই সঙ্গে থানায় একটি মামলা দায়ের মাধ্যমে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করে। কিন্তু দীর্ঘ ৭ বছর তদন্ত করেও ডিবি হত্যার সম্পূর্ণ রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। পরে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
তিনি আরও বলেন, ‘পিবিআই দীর্ঘ দুবছরের অনুসন্ধান শেষে চলতি বছরের গত ২৯ ফেব্রুয়ারি চাঞ্চল্যকর সুজন হত্যা মামলার সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে সুজনের সাবেক স্ত্রী আছমা আক্তার ইভাকে (৩২) দুপুর সাড়ে ১২টার সময় কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাধীন মধ্য ইছাপুর গ্রামে তার বর্তমান শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ইভার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইভার দুই ভাই মো. আরিফুল হক ওরফে আরিফ (৩৪) ও মো. রানা ওরফে বাবুকে (২৪) ১ মার্চ রাত পৌনে ১টার সময় নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন দাপা ইদ্রাকপুর এলাকা থেকে অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করা হয়।’
মামলার বরাত দিয়ে পিবিআইয়ের এএসপি ওসমান গনি বলেন, ‘গত ২০১১ সালের ১৪ মার্চ সুজনের বাবা মাটির ঠিকাদারি ব্যবসায়ী মো. আব্দুল মান্নান বিকাল ৪টার দিকে জানতে পারেন তার মেজ ছেলে সুজন (২৬) বন্ধু কুটির (২৫) সাথে বাসা থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সুজন বাসায় না ফিরলে আব্দুল মান্নান এর স্ত্রী হাফসা বেগম ছেলের মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পান। রাতে খোঁজ করে কোন সন্ধান না পেয়ে সকালে তার ছেলের বন্ধু কুটির বাসায় যান। কুটি জানায় ওইদিন মাগরিবের আযানের পর সুজনকে সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগ রেখে আসছে। তারপর থেকে তিনি তার নিখোঁজ ছেলের খোঁজ করতে থাকেন। পরে গত ১৮ মার্চ দুপুর ২টার সময় বিভিন্ন লোকজনের মুখে শুনেন সবুজবাগ থানাধীন দক্ষিণ রাজারবাগ বাগপাড়া শেষমাথা খালের ময়লা পানিতে কচুরী পানার সাথে ভাসমান অবস্থায় একটি অজ্ঞাত গলিত ও গলায় ফাঁস লাগানো লাশ পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে সবুজবাগ থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এ সংবাদ পেয়ে আব্দুল মান্নান ও তার পরিবারের লোকজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে লাশের দেহের বর্ণনা দেখে লাশটি তার ছেলের নিশ্চিত হয়ে সনাক্ত করেন। তার ছেলে সুজন গ্রিলের মিস্ত্রির কাজ করতো।’
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
২০০৮ সালে সুজন ইভাকে বিয়ে করে এবং ২০০৯ সালে সুজনের স্ত্রী সুজনকে তালাক দেয়। তালাক দিলেও ভিকটিম সুজন ইভার বাড়ির আশেপাশে যাওয়া আসা করতো। কিন্তু ইভার সঙ্গে সুজনের বিয়ের আগে থেকেই ফজলু (২৫) নামে একজনের সঙ্গে ইভার প্রেম ছিল। আবার ফজলু ইভার ভাই আরিফের বন্ধু। এ কারণে তাদের মধ্যে ইভা-সুজনের বিয়ে নিয়ে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। এতে সুজনকে ঘটনাক্রমে দু’একবার মারপিটও করেছিল আরিফ-ফজলু। ওই ঘটনার জেরেই সুজনকে হত্যা করে তারা।
ঘটনাটির আঁচ করতে পেরে সেসময় সুজনের বাবা আব্দুল মান্নান বাদী হয়ে সবুজবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৫৬। ওই মামলাটি প্রথমে সবুজবাগ থানা পুলিশ ও পরবর্তীতে ডিবি দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর তদন্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তদন্তে ঘটনার প্রকৃত রহস্য ও ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত পলাতক আসামি ইভা তার ভাই আরিফ ও বাবুর পূর্নাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেয়া হয়। ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নিহত সুজনের বাবা নারাজির আবেদন করেন। পরে আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্ত করার নির্দেশ দেন।
এএসপি ওসমান বলেন, ‘দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআইয়ের বিশ্বস্ত গুপ্তচর ও আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হই আমরা। পরে মামলাটির তদন্ত তদারককারী অফিসার পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদার নেতৃত্ত্বে একটি বিশেষ টিম অভিযান পরিচালনা করে সুজন হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করে ১ মার্চ। তাদের গ্রেফতারের পর তারা সুজন হত্যায় ফজলুর পরিকল্পনার কথা জানান।’
আসামিদের বরাত দিয়ে এএসপি ওসমান বলেন, ‘আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআই জানতে পারে, ২০০৮ সালে ভিকটিম সুজনের সাথে ইভার বিয়ে হয় এবং ২০০৯ সালে ইভা সুজনকে ডিভোর্স দেয়। সুজন ইভাকে খুব ভালবাসতো। ডির্ভোস দেওয়ার পরও সুজন প্রায় সময় ইভাকে দেখার জন্য তাদের এলাকায় আসা-যাওয়া করতো। পরে ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ সন্ধ্যার পর আরিফুল হক, ফাজলু তাদের বন্ধু কুটি ও কালা বাবু ইভাদের বাসার সামনে মাঠে বসে সুজনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পরের দিন ১৪ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টার সময় আরিফ তাদের বাসার পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি সাদা পলিথিন ব্যাগ নেয়। ফাইজুল ও আরিফ লাঠি নিয়ে নিকটস্থ খালপাড় বালুর মাঠের দিকে যেতে থাকে। এরই মধ্যে কুটি চলে আসে। তারা তিনজন এক সাথে খালপার বালুর মাঠে অপেক্ষার কিছুক্ষণের মধ্যে কালা বাবুও চলে আসে। রাত আনুমনিক ৮টার দিকে কুটির সাথে যোগাযোগ করে ভিকটিম সুজন খালপাড় বালুর মাঠে আসে। বিভিন্ন কথাবার্তার একপর্যায় ফজলু সুজনকে পিছন থেকে হাত দুইটি আটকে ধরে। এ সময় আরিফ পকেট থেকে পলিথিন বের করে কুটিকে দেয়। কুটি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে সুজনের মাথার উপর থেকে গলায় ঢুকিয়ে দিয়েই গলার মধ্যে পেচ দিয়ে গিট দিয়ে ফেলে। আরিফ লাঠি হাতে নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। পরে কালা বাবু আরিফ এর হাত থেকে লাঠি নিয়ে সুজনকে পেটাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরই সুজন মাটিতে লুটিয়ে পরে। সুজন মারা গেছে নিশ্চিত হয়ে তারা ধরাধরি করে লাশ পাশের খালে ফেলে দেয়। কুটি এবং কালা বাবু খালের নিচে নেমে সুজনের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেয়। পরে তারা সবাই এলাকায় চলে আসে। ফাজলু আরিফকে একটি বিয়ার দিয়ে বলে বিষয়টি কেউ দেখে নাই, সুতরাং চিন্তা করার কিছু নাই। ঘটনার পরের দিন সুজনের বাবা ইভাদের বাসায় এসে সুজনের বিষয়ে খোঁজ করে। সুজন তাদের বাসায় আসেনি জানালে তার বাবা চলে যায়।’
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্যান্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে জানান পিবিআইয়ের এএসপি ওসমান গনি।