Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দক্ষিণের সুখ-অসুখ: বদলেছে অর্থনীতি, বদলে গেছে মানুষ


৯ মার্চ ২০১৮ ১১:৩২

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

পিরোজপুর ও বাগেরহাট থেকে ফিরে: কৃষ্ণনগরের একটি চায়ের দোকানের সামনে একচালা টিনের লম্বা শেড। এখানে বসে অলস সময় কাটা এলাকার কারো কারো। সন্ধ্যার পর সোলারের আলোতে তাস খেলা চলে হরদম। দোকান আর সেডের মাঝখানের সরু রাস্তাটি পিচঢালা হয়েছে মাসকয়েক আগে। শেডের সামনের বেঞ্চিতে বসে জনৈকের নাম ধরে কর্কশ গালাগাল করে যাচ্ছেন বিবেক বাড়ই নামের এক জন। তার কথায় বোঝা গেলো প্রতিবেশি কারো সঙ্গে টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। ক্ষিপ্ত বিবেক তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি ধমকি করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ অবশ্য সামনে নেই। তবে একা বিবেকের খিস্তি-খেউড় মাঝ-বিকেলের নির্জনতাকে ভেঙ্গে সরগরম করে তুলেছে।

বিজ্ঞাপন

গালাগাল করে শান্ত হওয়ার পর বিবেকের সঙ্গে আলাপ জমে। কথায় কথায় জানালেন, ঘের নিয়ে প্রতিবেশি একজনের সঙ্গে বিবাদ চলছে। আর এও জানা গেলো- বিবেক প্রথম নয়, ওই প্রতিবেশিই তাকে এরই মধ্যে একদফা হাত-পা ভেঙে দেওয়ায় হুমকি ধমকি করে গেছেন। এখন পাল্টা হুমকি-ধমকি দিলেন তিনি। দুজনের ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত। তবে স্থান একটাই এই চায়ের দোকানের সামনে লম্বা টিনশেড।

দোকানে অন্য যারা ছিলেন তাদেরই একজন বললেন, গ্রামে এখন সবার কাছে নগদ টাকা-পয়সা। তাই কেউ কাউকে দাম দেয় না। কেউ কারো চেয়ে কম না। বললেন, এখানে এখনতো সবাই মহাজন’।

কথা বলে বুঝা গেলো- গত দেড় দশক আগে এ এলাকায় ঘেরে চিংড়ি চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে এ এলাকার অর্থনীতি বদলেছে। মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে। সেইসঙ্গে বদলেছে মানুষের চরিত্র, চাল-চলন, কথা-বার্তা এমনকী সম্পর্কের ধরণও।
বিবেক বাড়ই পাশে থেকে বলে উঠলেন, ‘এখন কে কার ***য় আঙ্গুল দেবে শুধু সেই চিন্তা’। বুঝা গেলো তার মেজাজ তখনও শান্ত হতে বাকি।

বিজ্ঞাপন

বয়স ষাটের কোটায়। ধীরে ধীরে জানালেন, দুই ছেলের কারোই পড়াশুনা বেশিদুর এগিয়ে নিতে পারেনি। মাধ্যমিকের গণ্ডিও পার করেনি। তবে বড় ছেলের বউ মাস্টার্স পাশ। আর ছোটো ছেলের বউ এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন। নাতি-নাতনি নিয়ে এখন সুখের সংসার তার।

অথচ তার সংসার শুরুর গল্পটি ছিলো সংগ্রামের। দুবেলা খাবার জোটাই ছিলো কষ্টসাধ্য। দুই দশক আগে এ এলাকায় প্রথম চিংড়ির চাষ শুরু হলে তাতে লেগে পড়েন বিবেক। তারপর থেকে গায়ে-গতরে খেটে এখন পর্যন্ত ৮/৯ বিঘা জমি-জিরেতও হয়েছে তার। তবে সে জমির সবটাই ঘের। সেখানে জলে মাছ আর ডাঙায় সবজি চাষে বেশ মোটা অংকের নগদ টাকার মালিক এখন বিবেকের পরিবার।

বদল এসেছে মাছ চাষের ধরনেও। শুরুর দিকে সবাই চিংড়ি চাষ করলেও এখন আর তা নেই। নানা কারনে ধীরে ধীরে মার খেয়েছে গলদা চিংড়ি। যায়গা করে নিয়েছে সাদা মাছ। তাতেও লাভ একেবারে কম না।

‘এখন গলদার চাষ করি না তাতে কি হইছে, সবজিতে বাম্পারে আছি দাদা। এই ধরেন টমেটোতেই এবার লাখ দুই টাকা লাভে আছি। শসা, করলা, লাউ-কুমড়া, আলুসহ এমন কোনো সবজি নেই যা হয় না ঘেরের আলে,’ বলেন বিবেক বাড়ই।

কেবল তিনিই নন, দক্ষিণের এ জনপদে এমন চাষী প্রায় সকলেই। যার যতটুকু জায়গা জমি তাতেই মাছ-সবজির চাষ হয় বারো মাস। এখানকার হাটে-ঘাটে প্রায় সারাবছরই দেখা মেলে নানা জাতের মাছ-সবজির। প্রত্যন্ত গ্রামে ভোর থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত চলে পণ্য বিপণনসহ যাবতীয় কাজকর্ম।

কৃষিতে বাগেরহাটের সঙ্গে পিরোজপুরের পার্থক্য থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নতিতে খুব একটা পার্থক্য নেই। বলেশ্বরের দু’পারেই মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের বয়স সাকুল্যে দুই দশকও হয়নি। নদের পশ্চিমে উন্নয়নের প্রধান বাহক ‘সাদা সোনা’ খ্যাত গলদা চিংড়ি আর পূর্বপাশে নগরমূখীতা। সবমিলে পূর্ব-পশ্চিমের মানুষ এখন নগদ টাকায় স্বাবলম্বী।

কৃষিতে বরিশাল ও খুলনার বিশাল এ অঞ্চলে এখনো পার্থক্য চোখে পড়লো। বরিশাল অঞ্চলের নাজিরপুরের সামন্তগাতীর মাঠগুলোতে সবুজ ধানের ওপর ফাগুনের বাতাস দোলখাচ্ছে। তার একটি দূরে বলেশ্বরের ওপারে চিতলমারির বাওয়ালীপাড়ায় মাঠগুলো ঢাকা পড়েছে সবজি মাচার নীচে। সেখানে ঘেরগুলোর উপর নীচে কেবল টাকা আর টাকা।

অর্থনীতির চাকা যে ঘুরেছে তা চোখে পড়বে এ অঞ্চলের গ্রামগুলো ঘুরলে। কাঠের ঘরে টিনের চাল ক্রমেই কমছে। বাড়িতে বাড়িতে উঠছে একতলা-দোতলা পাকা ঘর। মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠছে মিনি বাজার। একসময় গ্রামে সপ্তাহে দুদিন যে হাটগুলো বসতো এখন সেখানে প্রতিদিনই বাজার বসছে।

তবে সপ্তাহে দুদিন হাটের যে যুগ ছিলো সেটাই নাকি ভালো ছিলো এমন অভিমত গ্রামবাসীর।

কৃষ্ণনগর উত্তরপাড়া। একেবারে অজপাড়া গাঁ। এই গ্রামে সম্প্রতি বিদ্যুতের খুটি বসেছে। তাতে তার টানা হয়নি। তবে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো রয়েছে। এ আলো সোলারের। একটি গৃহস্থ বাড়ির উঠোন ঘেঁষে প্রায় একযুগ ধরে টেইলারিংয়ের কাজ করছেন অজয় মন্ডল নামের এক যুবক। তার বাড়ি নাজিরপুরের সামন্তগাঁতী গ্রামে। ছোট্ট বাঁশ-কাঠের দোকানটিতে দুইটা সেলাই মেশিন। তাকে সাজানো থান কাপড়। সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে কয়েকটি শার্ট-প্যান্টও। তিনি জানালেন, আশপাশের মানুষরাই তার দোকান থেকে জামাকাপড় বানায়। সব খরচ বাদেও মাসে যা থাকে তা দিয়ে এখন অনেক স্বচ্ছল তার পরিবার। সারা মাস কাজ একদম কম না হলেও পুজোর সময় অনেক টাকার কাজ করেন বলে জানান অজয়।

এ বিষয়ে তারাবুনিয়া গ্রামের সমাজকর্মী সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, আগে মানুষের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিলো, গ্রামের মানুষ প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই করতো সপ্তাহে দুদিন। হাটের দিন অনেক লোকের সমাগম হতো। এক হাটের পর অন্য হাটের জন্য অপেক্ষা করতো গৃহস্থরা। কিন্তু এখন সে অবস্থা পাল্টেছে। আধুনিক বাজার ব্যবস্থা মানুষের রুচি আর প্রয়োজনকে ভিন্নভাবে প্রবাহিত করছে। এতে ভালমন্দ দুটোই আছে বলে মনে করেন তিনি।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে এমন পরিবর্তনের বিষয়ে নাজিরপুরের মাটিভাংগা ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মাটিভাংগা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এবিএম রেজাউল করিম বলেন, নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসে শিল্পায়নের প্রভাব পড়তে শুরু করে দক্ষিণের এ অঞ্চলে। কৃষি ভিত্তিক গ্রামগুলোতে শহর থেকে নগদ টাকার প্রবাহ আসতে থাকে। সেই থেকে পরিবর্তনের শুরু। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক নানা কারণে গ্রামীণ অবকাঠামো ও অর্থ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে। এতে করে মানুষের মধ্যে গতি বাড়লেও সামাজিক –সাংস্কৃতিক কিছু বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার মতে, সমাজের সব শ্রেণির হাতে নগদ টাকা থাকায় সামাজিক সম্প্রীতি কমেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। গ্রামীণ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি প্রভাব এবং বিভক্তিও নানাভাবে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী।

এদিকে মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে এমন এ মন্তব্য করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগে মানুষের আয় কম ছিলো তারা মাস কিংবা সপ্তাহ ভিত্তিক বাজার করতো। সে সময় হাটে দূরদূরান্ত থেকে পণ্য আসতো। কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে গ্রামীণ বাজার ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এখন আর হাটগুলো জমে না। এতে করে মানুষের সুবিধা হলেও কিছু কিছু সনাতনী পণ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। তবে সে সব সনাতনী পণ্যের জন্য এখন আলাদা বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন এ অর্থনীতিবিদ।

দক্ষিণের সুখ-অসুখ: এখানে নদী মরে লোভ আর নির্যাতনে
দক্ষিণের সুখ-অসুখ: খাবার পানি নিয়ে বাড়ছে কলহ-বিভেদ!

সারাবাংলা/এমএস/এমএম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর