ওয়াসার খাল হস্তান্তরে নেই অগ্রগতি, মধ্য আগস্টে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা
১১ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩০
ঢাকা: চলছে বর্ষা। বর্ষা মানেই মুষলধারায় বৃষ্টি। বর্ষার বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ভাসে দেশ। তবে রাজধানী ঢাকায় বর্ষার আবহে বন্যা খুব একটা আসে না। কিন্তু একটু বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা যে রূপ নেয় তা বন্যার চেয়ে কমও বলা যায় না। আর এই জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো রাজধানীর খাল ও নালা হারিয়ে যাওয়া। খাল পুনরুদ্ধারে গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছে ওয়াসা। কিন্তু এর জন্য শত কোটি টাকা খরচ হলেও উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
তাই দ্রুত ওয়াসার দায়িত্ব থাকা রাজধানীর প্রায় ৪০টি খালের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দিতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দেয় দুই মেয়র। কিন্তু এই প্রস্তাবের ১৫ দিন পেরিয়ে গেলেও খাল হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় নেই কোনো অগ্রগতি। এমনকি সহসাই হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও দেখছে না দুই সিটি। এদিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, মধ্য আগস্ট থেকে ফের টানা কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। আর ওই সময়ে রাজধানীতে ফের জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা যেন নিত্য সঙ্গী রাজধানীবাসীর। গত কয়েক বছরের অব্যাহত এ সমস্যার সমাধানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও মেলেনি না স্বস্তি। উল্টো সমস্যা আরও প্রকোট হচ্ছে। এতে একদিকে নগরবাসী যেমন ত্যাক্ত-বিরক্ত, তেমনি জলাবদ্ধতার দাপটে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও যেন হাঁপিয়ে উঠছে রীতিমতো।
ঢাকা দক্ষিণ এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নের লক্ষ্যে নগরের অন্য আট-দশটি সমস্যার সমাধানে সুনাম অর্জন করলেও, জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধান করতে না পারায় সে অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আর এজন্য ওয়াসা-ই একমাত্র দায়ী বলে মনে করছে দুই সিটি করপোরেশন।
কারণ হিসেবে তারা বলছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঢাকার খালগুলো পরিষ্কার রাখা এবং সেগুলো নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। আর এ দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু ওয়াসা এ কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার খালগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও দেখা যায়নি ওয়াসার। সেজন্য ওয়াসার দায়িত্ব থাকা রাজধানীর প্রায় ৪০টি খালের দায়িত্ব দুই সিটিকে দিতে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা, খাল পুনরুদ্ধারে শত কোটি টাকা জলে
গত ২২ জুলাই দুপুরে জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় নির্ধারণ করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ওয়েবিনারে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় অংশ নেন। সভায় দুই মেয়র স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা তুলে ধরে প্রস্তাব করেন, ওয়াসার তত্ত্বাবধানে থাকা রাজধানীর ৪০টি খালের দায়িত্ব যেন সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে দুই সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালগুলো ব্যবহার করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে। এমন প্রস্তাবের পর মন্ত্রী দুই মেয়রকে নিয়ে ওয়াসার কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শনে যান এবং পরিদর্শনে গিয়ে খালগুলোর বেহাল চিত্র দেখতে পান।
এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরের মানুষ যাতে দুর্ভোগের সম্মুখীন না হয় সেজন্য চেষ্টা করব। আর দুই মেয়র যে প্রস্তাব দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর পার হয়ে গেছে ১৮ দিন। কিন্তু জলাবদ্ধতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন থেমে গেছে সেই উদ্যোগ। নেই সেদিনের মত তেমন তোড়জোড়।
ওয়াসার দায়িত্বে থাকা খালগুলো হস্তান্তর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কী?- জানতে চাইলে সোমবার (১০ আগস্ট) স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই মেয়র একটা প্রস্তাব দিয়েছে। সেটি আমরা আমলে নিয়ে মিটিংও করেছি। কিন্তু কথা হলো একেক সময় একেক প্রস্তাব দিলে কোনটা নেবো। একবার বলবেন, এটা ফেলে দেন। আবার বলবেন, এটা ফেলে দিলেন কেন? এভাবে তো হতে পারে না। এক সময় কাজটা সিটি করপোরেশন করতে পারেনি বলেই তো ওয়াসাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন যদি আবারও সিটি করপোরেশন করতে চায় তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কারণ কাজটি সিটি করপোরেশনের। তবে কাজটি করতে হলে তাদের তো সেই পরিমাণ ক্যাপাবিলিটি থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তো যথেষ্ট পরিমাণে ইক্যুইপমেন্ট প্রয়োজন দুই সিটির। সেগুলোর তো ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবস্থা না করে তো হুট করে সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব হবে না। তাই ধীরে ধীরে দুই সিটির সে সক্ষমতা তৈরি করে কীভাবে দায়িত্ব হস্তান্তর করা যায় সে প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই চলছে।’
তিনি আরও বলেন,‘দুই মেয়রের প্রস্তাবটি আমি পর্যালোচনা করছি। খুব শিগগিরই নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। তাদের সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করব। তাদের থেকেও মতামত নেব। যেহেতু আমি দায়িত্বশীল মানুষ। তাই দায়িত্বহীন কোনো কাজ করতে চাই না। আমি যখন যেটা করব, বুঝে-শুনে করতে চাই।’
তবে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘খাল রক্ষাণাবেক্ষণের জন্য আমরা জনস্বার্ধে যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত। মন্ত্রী মহোদয়কে আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি যে, খালগুলো অবশ্যই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হউক। খালগুলোর যদি সঠিকভাবে পানির প্রবাহ সৃষ্টি না হয় তবে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়। এখন বাকি সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন। তবে আমরা সে আশায় বসে নেই। আমরাও নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে যতটুকু সম্ভব কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
মেয়র আতিক বলেন, ‘ইতোমধ্যে মগবাজার-মধুবাগ এলাকার জন্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। একাজে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দিচ্ছে মেট্রোরেল প্রকল্প। বাকি টাকা করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে। আশা করছি অতিদ্রুত ওই এলাকার জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃত সমাধান নিহিত রয়েছে খালগুলোতে। আমরা চাই যেকোনোভাবে খালগুলো সচল করতে।’
একই কথা জানালো ডিএসসিসিও। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহ মো. এমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে ডিএসসিসির আওতাধীন খালগুলো করপোরেশনকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। সেটি কোন পর্যায়ে আছে মন্ত্রণালয় থেকে এখনও কিছু জানায়নি। আশা করছি দ্রুত এটার বিষয়ে উদ্যোগ নেবে মন্ত্রণালয়।’
এদিকে, আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, আগামী ১৬ কিংবা ১৭ আগস্ট থেকে ফের টানা কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হতে পারে। আর এতে আবারও জলাবদ্ধতায় ডুববে রাজধানী ঢাকা।
আবহাওয়াবিদ আফতাব উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুলাইয়ের ২১, ২২ এবং ২৩ তারিখে থেমে থেমে সর্বোচ্চ ৫৮ মিলিমিটারের বৃষ্টিপাত হয়। আর তাতেই কোথাও হাঁটু পরিমাণ আবার কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি জমেছিল। এর জন্য দায়ী হলো- খালগুলো যেমন কার্যকর নয়, তেমনি জনগনও সচেতন নয়। যততত্র প্লাস্টিক দ্রব্য ফেলে রাখে। এতে পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে আগামী সপ্তাহে ফের জলাবদ্ধতায় ডুবতে পারে রাজধানী।
এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ওয়াসা খাল হস্তান্তর জলাবদ্ধাতা ডিএনসিসি ডিএসসিসি মধ্য আগস্ট মেয়র আতিক মেয়র তাপস