হুমায়ুন আজাদ: সজারু শত্রু কিংবা জল্লাদ মিত্র
১২ আগস্ট ২০২০ ২০:০৩
সমসাময়িক কিংবা সমবয়সী লেখকদের তুলনায় হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) ‘গড়পড়তা’ আলোচিত সাহিত্যিক নন। এই অভিমতের পেছনে কারণ হলো, হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে যারা আলোচনা করেন কিংবা যারা তাকে পঠন-পাঠন করেন তারা অন্য সব পাঠকের মতো গড়পড়তা নন। এদের অধিকাংশই প্রগতিতে বিশ্বাসী। এ কথা অনিবার্য যে প্রায় ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে দুঃখজনক হলেও নির্মম নিয়তি যে এখনও মানুষ অন্ধকার বিশ্বাস করেন, এখনও কুসংস্কার বিশ্বাস করেন, এখনও ধর্মের নামে গোঁড়ামিতে নিমজ্জিত থাকেন জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ। সেই বিশাল অংশের বাইরে হুমায়ুন আজাদকে যারা পড়েন বা যারা তাকে বিশ্লেষণ করেন তারা অন্তত একটি ‘নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠক’ এরা বিজ্ঞান পছন্দ করেন, এরা যুক্তি পছন্দ করেন, এরা বিশ্বাস করেন মুক্ত আলোচনায়।
এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে মুক্তির কথা-যুক্তির কথা শুনতে চান এরকম মানুষ হাতে গোনা। বলা যায় তারা একেবারের সংখ্যালঘু। স্বভাবত, তাই হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুই-একটা আলোচনা হলেও তাকে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা একদমই কম। কারণ হলো হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে যারা কথা বলতে চান তাদেরকে অনেক হিসাব-নিকাশ করে কথা বলতে হয়। স্থান-কাল-পাত্রভেদের ক্যালকুলেশনটা সচেতনভাবেই মনে রাখতে হয়।
বাস্তবতা হলো হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে সভা-সেমিনার-আলোচনা ওই অর্থে নেই। তারপরও আলোর সন্ধানী মানুষদের কাছে হুমায়ুন আজাদ এখনও কি অনিবার্য নন? বাংলা সাহিত্যে এই অনিবার্য অবস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে হুমায়ূন আজাদকে কম পথ পেরোতে হয়নি, কম সমালোচনা সহ্য করতে হয়নি, কম আলোচনায় আসতে হয়নি তাকে। কারও কাছে শত্রু হয়েছেন নিজের কর্মের জন্য আবার কারও মিত্র হয়েছেন ওই একই কর্মগুণে।
যারা তাকে পথের কাঁটা মনে করতেন এরকম গোষ্ঠীর হাতে আক্রান্তও হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। প্রকাশ্যে তাকে রক্তাক্ত করা হয়েছিল তার প্রাণের ক্যাম্পাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ওই কুসংস্কারাচ্ছন্ন-অন্ধকারাচ্ছন্ন গোষ্ঠীর কাছে নির্ঘাত শত্রু বলেই হুমায়ুন আজাদ এমনভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শত্রুর হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে সহানুভূতি জানিয়েছেন এমন মিত্রের সংখ্যাও ছিল অগণিত। সেই অর্থে শত্রু ও মিত্রের সঙ্গে বসবাস করে হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পরও আমাদের কাছে, আমাদের সাহিত্য-সমাজের কাছে অনিবার্য হয়ে উঠেছেন।
মানুষ হিসেবে তার অনেক অপরাধ হয়ত থাকতে পারে। কারও কারও কাছে তিনি অগণিত ভুলে ভরা একজন মানুষ। কিন্তু দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে এমন অকপট ভালোবাসা দেখাতে পেরেছিলেন কতজন? ‘আমরা কি এমন বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস দেখানোর সাহস রেখেছেন কতজন? যেখানে সাম্প্রদায়িকতা, যেখানে রাজাকার সম্প্রদায়ের উত্থান, যেখানে জঙ্গিবাদের বিস্তার সেই অস্বস্তিকর সমাজ-বাস্তবতায় স্রোতের বিপরীতে হেঁটে তার মতো লেখনিকে শাণিত রাখা বিরল সাহসিকতার কাজ বটে। হুমায়ুন আজাদ তাই স্বভাবতই প্রথাবিরোধী লেখক। সমাজ-সংস্কৃতির ‘সবকিছু ভেঙে পড়া’র মধ্যেও তার লেখক সত্তায় মিশে ছিল ‘ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের’ ভাবনা।
এই ভাবনার জায়গা থেকেই তিনি রচনা করেছেন ৭০টির মতো গ্রন্থ। তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১২। তার উপন্যাস ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’ (১৯৯৪), ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ (১৯৯৫), ‘মানুষ হিশেবে আমার অপরাধসমূহ’ (১৯৯৬), ‘শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ (১৯৯৭), ‘রাজনীতিবিদগণ’ (১৯৯৮), ‘কবি অথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ (১৯৯৯), ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’ (২০০০), ‘ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ’ (২০০১), ‘শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্তজবা’ (২০০২), ‘১০,০০০ এবং আরো ১টি ধর্ষণ’ (২০০৩), ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ (২০০৪), ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ (২০০৪)।
কবিতা, উপন্যাস, শিশু সাহিত্যের পাশাপাশি অসংখ্যা নিবন্ধও লিখেছেন তিনি। গণতান্ত্রিক সমাজের নামে অগণতান্ত্রিক রীতি-নীতির বিরুদ্ধাচারণ ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে লেখালেখি ছিল যার উপজীব্য। তার প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্যপ্রবন্ধ’ (১৯৮৮), ‘ভাষা-আন্দোলন: সাহিত্যিক পটভূমি’ (১৯৯০), ‘নারী’ (১৯৯২), ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ (১৯৯২), ‘নিবিড় নীলিমা’ (১৯৯২), ‘মাতাল তরণী’ (১৯৯২), ‘নরকে অনন্ত ঋতু’ (১৯৯২), ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ (১৯৯২), ‘রবীন্দ্র প্রবন্ধ/রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা’ (১৯৯৩), ‘শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা’ (১৯৯৩), ‘সীমাবদ্ধতার সূত্র’ (১৯৯৩), ‘আধার ও আধেয়’ (১৯৯৩), ‘আমার অবিশ্বাস’ (১৯৯৭), ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম: সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা’ (১৯৯৭), ‘মহাবিশ্ব’ (২০০০), ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (মূল: সিমোন দ্য বোভোয়ার, ২০০১), ‘আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম’ (২০০৩), ‘ধর্মানভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ (২০০৪) প্রভৃতি।
মানুষ হিসেবে হুমায়ুন আজাদের অনেক অপরাধের একটি হলো তিনি কথা বলেছেন স্পষ্টভাবে। তার অপরাধ ধর্মের নামে অধর্মের চর্চার মূলোৎপাটন করতে চেয়েছেন। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, যা উপলব্ধি করতেন সেটিই প্রকাশ করেছেন অকপটে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার হিসাব-নিকাশ করেননি। তিনি অকারণে কারও প্রতি অযৌক্তিক প্রশংসা করেননি। যা ভালো তা মেনে নিয়েছেন, যা অন্যায্য সেটার বিরুদ্ধে কলম শাণিত করেছেন। এভাবেই হুমায়ুন আজাদ হয়ে উঠেছেন একটি নির্দিষ্ট পাঠক শ্রেণির জন্য অনিবার্য কলম সেনাপতি। আর আমাদের জন্যও তিনি হয়েছেন অনিবার্য আলোচনার বিষয়বস্তু।
নিজ বিশ্বাসে অটল-আস্থাশীল থাকায় হুমায়ুন আজাদ শুধু উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর কাছেই শত্রুতে পরিণত হননি বৈরী সম্পর্কের মুখোমুখি হয়েছেন সমসাময়িক কিংবা সমবয়সী অনেক লেখকের কাছেও। তাই তাকে ঘিরে একটা বিতর্ক, একটা আলোচনা থাকতই ওই সময়ের দৈনিক পত্রিকা কিংবা সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে।
১৯৯৮ সালে দৈনিক মানবজমিনে হুমায়ুন আজাদ এক সাক্ষাৎকার দেওয়ায় আহমদ ছফা তার প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছিলেন। আহমদ ছফার অভিমত ছিল অগ্রজ সাহিত্যিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছিল ওই সাক্ষাৎকারে।
আহমদ ছফা লিখেছিলেন, হুমায়ুন আজাদ অনেক নামিদামী মানুষের উষ্ণীষ বাক্যের খড়-খড়গাঘাতে ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছেন। যারা হুমায়ুন আজাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, এক সময়ে তাদের অনেককে তিনি ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। উপকার করলে অপকারটি পেতে হয়- এই আপ্তবাক্যটি হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। শুয়োরের বাচ্চার যখন নতুন দাঁত গজায়, বাপের পাছায় কামড় দিয়ে শক্তি পরীক্ষা করে। হুমায়ুন আজাদের কোনো উপকার আমি কোনদিন করিনি, তথাপি কেন তিনি অনুগ্রহটা করলেন, সেটা ভেবে ঠিক করতে পারছিনে। সত্য বটে, একবার তাঁকে আমি সজারুর সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। সেটা একটুও নিন্দার্থে নয়।’
আহমদ ছফার মতে আসলেই হুমায়ুন আজাদ এক সজারু। বাঘ, সিংহ কিংবা অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী নয়।
‘লেখক হিসেবে আমি যে কত সামান্য সেটা অনেকের চাইতেই আমি অনেক বেশি ভাল জানি। অনেকে আমার নাম উল্লেখই করেন না। অন্তত হুমায়ুন আজাদ গাল দেয়ার জন্য হলেও আমার অস্তিত্বটা অস্বীকার করেননি, সেজন্য হুমায়ুন আজাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আর এটা একটুও মিথ্যে নয় যে, আমি জন্তু-জানোয়ার নিয়ে কাটাই। আমার জন্তু-জানোয়ারের সংগ্রহশালাটি যদি আরও বড় হত, সেখানে আজাদের জন্যও একটা স্থান সংরক্ষণ করতাম।’
হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আহমদ ছফা আরও লিখেছিলেন, হুমায়ুন আজাদ উপন্যাস, কবিতা অনেক কিছু লিখেছেন। সেগুলো সবটা একেবারে খারাপ সেকথাও আমি বলব না। মাঝে মাঝে নাড়াচাড়া করে দেখেছি, চিবানোর যোগ্য পদার্থ তাতে অধিক খুঁজে পাইনি। তথাপি হুমায়ুন আজাদ একজন সুপরিচিত লেখক। ভ্যালু তৈরি করতে না-পারুন, ন্যুইসেন্স ভ্যালু তৈরি করার ক্ষমতা তাঁর অপরিসীম। আমাদের উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে যে নৈরাজ্য, সন্ত্রাস এবং দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে, হুমায়ুন আজাদের লেখার মধ্যদিয়ে সেগুলোরই অভিব্যক্তি ঘটেছে। এক কথায় হুমায়ুন আজাদকে আমি এভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে চাই- স্বভাবে কবিতা লেখে, পেশায় জল্লাদ, খিটিমিটি মানবক হুমায়ুন আজাদ।’
এই তর্ক-বিতর্ক-আলোচনা ‘উঁচু মানুষদের ব্যাপার-স্যাপার।’ তবে আহমদ ছফার কাছ থেকে শব্দ ধার করলে হুমায়ুন আজাদ আসলেই ‘জল্লাদ’। যারা ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলেকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন, যারা সবকিছু নষ্ট করেছেন, যে সব নষ্টরা অধিকার করে নিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি এমনকি ক্ষমতার চেয়ার তাদের জন্য হুমায়ুন আজাদ এক ক্ষুরধার জল্লাদ।
তাই এই ‘জল্লাদ সময়ে’ এই ‘অন্ধকার সময়ে’ হুমায়ুন আজাদের চর্চা আরও ব্যাপকভাবে আমাদের মাঝে জরুরি। তর্ক কিংবা আলোচনা-সমালোচনা কিংবা যুক্তিবোধকে শাণিত করার জন্য হলেও হুমায়ুন আজাদ নামে ‘সজারু শত্রু’ কিংবা ‘জল্লাদ’ মিত্র আমাদের অতীব জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও পিএইচডি গবেষক।
তথ্যসূত্র
(১) আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ একটা সজারু, মানবজমিন, ১ ডিসেম্বর, ১৯৯৮।
(২)জাকির তালুকদার, বিতর্কে জড়ানো আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, অন্য লেখক, NTV Online, ১২ আগস্ট ২০১৫।
(৩) কবীর আলমগীর, আহমদ ছফার উপন্যাসে সমাজ ও জীবন, ২০১৮, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা।
কবীর আলমগীর ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ