‘করোনা প্রতিরোধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ লোক দেখানো’
১৪ আগস্ট ২০২০ ১১:৫৮
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এক পরিচিত মুখ। বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনকে যারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের অন্যতম তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত সেলিম। ছেষট্টিতে স্কুলে থাকতেই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নেন, সেই মিছিল থেকে আটক হয়ে কারাবরণও করেন। কলেজে উঠেই বাম ধারার ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতিতে যুক্ত হন। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, পরে সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া সেলিম স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম নির্বাচিত সহ–সভাপতি (ভিপি)।
মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ–কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ছাত্রজীবন শেষ করেও বাম ধারার রাজনীতিতেই যুক্ত থাকেন। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হন তিনি।
ছাত্রজীবনেই গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সেলিম। পরে ক্ষেমজমুর সমিতির সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিপিবি) সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১২ সালে দশম কংগ্রেসে সিপিবি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। সেই পদেই এখনো আসীন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ।
সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে দেশের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সমালোচনা করেন সিপিবি সভাপতি সেলিম। একইসঙ্গে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও নিজের মত তুলে ধরেন। মোবাইল ফোনে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আজমল হক হেলাল
করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকার কেমন করেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সাফ জবাব, সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, মহামারি প্রতিরোধের জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা লোক দেখানো। সরকারের বদনাম যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করার জন্য যতটুকু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তাই নিয়েছে। একটি বৈশ্বিক মহামারিকে সত্যিকার অর্থে ঠেকাতে চাইলে জানুয়ারি থেকে যখন বিপদ সংকেত বইছিল, তখনই সরকার শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারত। সরকার তা করেনি। এমনকি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যেত, সেটাও নেয়নি।
স্বাস্থ্যসেবা না বাড়িয়ে সরকার দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করেছে বলে অভিযোগ করেন সেলিম। তিনি বলেন, করোনার শুরুতে যদি সরকার সারাদেশে স্বেচ্ছাসেবক স্বাস্থ্যকর্মী অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিত, তাদের খণ্ডকালীন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে করোনা মহামারিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা হতো না। কারণ ওইসব স্বেচ্ছাসেবক স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে সারাদেশে স্বাস্থ্যবিধি প্রচার ও নমুনা সংগ্রহসহ ক্লিনিকগুলো সচল রাখা যেত। দেশের জনগণ চিকিৎসা পেত। কিন্তু সরকার এসব না করে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করেছে। ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মাস্কসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের সীমাহীন দুর্নীতি এখন জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে।
করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এ অবস্থায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষদের সরকার বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। সরকারের এ কার্যক্রমকে কিভাবে দেখছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, করোনা মহামারিতে সরকারের উচিত ছিল বাজেট পুনর্বিন্যাস করে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ দেওয়া। জনগণকে বলা উচিত ছিল, আপনারা ছয় মাস ঘরে থাকুন। ঘর থেকে বের হবেন না। আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা আমরা (সরকার) করব। রেশন কার্ড করে দিয়ে ছয় মাস বিনা পয়সা জনগণকে খাবার সরবারহ করা যেত। বাজেটের শতকরা ৫ ভাগ অর্থ প্রদান করলে ২ কোটি পরিবারকে সহায়তা দিতে পারত। সরকার এসব কিছুই করেনি। মহামারির শুরু থেকেই সরকার সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি। ফরে করোনায় দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার করোনার বুলেটিন প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এলেও অফিস-আদালত খুলে দিয়েছে। সরকার এসব সিদ্ধান্ত মোটেও সঠিক হয়নি।
করোনাভাইরাস মহামারিতে সিপিবি বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা— জানতে চাইলে সিপিবি সভাপতি বলেন, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যাই করুক না কেন, মূল কাজটা সরকারকেই করতে হয়। তাছাড়া সিপিবি করোনা সংক্রমণের শুরুতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তি নিয়ে করোনা প্রতিরোধের জন্য পরামর্শ সভা করেছে। ওই সভার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠিয়েছি। সরকার আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সরকারের উচিত ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেটি সরকার করতে পারেনি।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কী বলবেন— এ প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই, রাজনীতি নেই, ভোট নেই। জনগণের কথা বলার অধিকার নেই। কথায় কথায় ক্রসফায়ার। দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতীতে আজ গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের মুখে। এসবের ফলে সম্প্রদায়িক শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীরা ওঁৎ পেতে আছে সুযোগ নেওয়ার জন্য। সুযোগ পেলেই দেশে অশুভ শক্তি মাথাচড়া দিয়ে উঠবে। অতীতেও এরকমই হয়েছে। আমি মনে করি, এসব কারণে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সরকারকে ‘জনসমর্থনহীন’ অভিহিত করে সিপিবি সভাপতি বলেন, বর্তমান সরকার সব ক্ষেত্রে দায়িত্বহীন আচরণ করছে। জনসমর্থনহীন এই সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করছে এবং সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। মোট কথা, সরকার লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাস্ত। এখন সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতার মসনদে টিকে আছে।
করোনা মহামারি করোনাভাইরাস গণতন্ত্র বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বৈশ্বিক মহামারি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম লুটেরাদের স্বার্থ সাক্ষাৎকার সামাজিক সুরক্ষা সিপিবি সভাপতি স্বাস্থ্য খাত