Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুর ‘রক্তাক্ত বিরোধিতার’ দায় এড়াতে পারে না জাসদ


১৫ আগস্ট ২০২০ ১৫:৪৭

ডা. মাহফুজুর রহমান। একাত্তরের রণাঙ্গনের সম্মুখসারির গেরিলা যোদ্ধা। ১৯৬২ সালে স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। উত্তাল ষাটের দশকের সব আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। ছিলেন ছাত্রলীগের স্বাধীনতাকামী নিউক্লিয়াস গ্রুপের সঙ্গে। ১৯৭০ সালে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর চট্টগ্রামের উপপ্রধান ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম শহরে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গঠিত হলে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং চট্টগ্রামে দলটির নেতৃত্বের কাতারে ছিলেন। আবার আশির দশকে জাসদের রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে দল ছাড়েন। একদল সহযোদ্ধাকে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা কেন্দ্র’। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় মাহফুজুর রহমানকে জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। রাজনীতি ছাড়লেও রাজপথ ছাড়েননি। গণঅধিকার মঞ্চ ও গণঅধিকার চর্চা নামে দুটি নির্দলীয় সংগঠন গড়েছেন। রাজনৈতিক-সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুতে নিয়মিত রাজপথে নামেন। এছাড়া চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সকল গণআন্দোলনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা আছে মাহফুজুর রহমানের।

বিজ্ঞাপন

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে বিয়োগান্তক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে বাঙালি জাতি, সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য জাসদের দায় কতটুকু, সেসময়কার প্রেক্ষাপটসহ নানা বিশ্লেষণ সারাবাংলার কাছে তুলে ধরেছেন মাহফুজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রমেন দাশ গুপ্ত ও ছবি তুলেছেন ফটো করেসপন্ডেন্ট শ্যামল নন্দী

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং এর প্রেক্ষাপটে জাসদের জন্ম। এটা অনিবার্য ছিল কি না— এমন প্রশ্নে মাহফুজুর রহমান স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ষাটের দশককে ইতিহাস মেনেছেন। মত দিয়েছেন, জাসদ গঠনে ছাত্রলীগের একাংশকে অনেকটা বাধ্য করা হয়েছিল।

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘১৯৬৬ সালেই আমাদের বোঝানো হলো— ছয় দফা পাকিস্তান কখনো মেনে নেবে না। তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হও। এর মধ্য দিয়েই ছাত্রলীগে একটা দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে গেল। একদল ছয় দফাপন্থী, আরেকদল স্বাধীনতাপন্থী। কেন্দ্রে ছয় দফার পক্ষে ছিলেন মণি ভাই (শেখ ফজলুল হক মণি), আর স্বাধীনতাপন্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান ভাই। চট্টগ্রামে স্বাধীনতাপন্থীদের মধ্যে ছিলেন মোক্তার ভাই, আবু মোহাম্মদ হাশেম, সাবের আহমেদ আজগরী, আবু ছালেহ কফিল উদ্দিন, তাদের মাথার ওপর ছিলেন এম এ আজিজ। আর ছয় দফার পক্ষে ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আর এস এম ইউসুফ। তবে দুই পক্ষই বাঙালির অধিকার প্রশ্নে অনড় ছিল।’

মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও দৃশ্যমান হওয়ার তথ্য দিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘অনেকেই বলেন, মুক্তিযুদ্ধে এফএফ-বিএলএফ দ্বন্দ্ব হয়েছে, আসলে সেটা সত্যি নয়। দ্বন্দ্ব হয়েছে বিএলএফ’র মধ্যেই। কারণ ছাত্রলীগের ওই দুই পক্ষই বিএলএফ’র মধ্যে ছিল, সেখান থেকে কাউকে কাউকে এফএফ বাহিনীতে পাঠানো হয়। এটা ছিল পরিকল্পিত, যেন এফএফটা ছাত্রলীগের বাইরে না যায়। যুদ্ধ শেষ হলো।’

বিজ্ঞাপন

‘যুদ্ধ শেষের পর এই দ্বন্দ্বটা আরও প্রকাশ্য রূপ নিল। ছাত্রলীগ প্রকাশ্যে ‍দুই ভাগ হয়ে গেল। দুই ভাগ হওয়ার পেছনে কার অবদান বেশি, সেটা আমরা জানি না বা বলতে পারব না। ইতিহাস সেটা বিচার করবে অবশ্যই। তবে দুই গ্রুপই মনে করত যে বঙ্গবন্ধু তাদের পক্ষে আছেন। আমরা যারা সিরাজুল আলম খানদের সঙ্গে ছিলাম, আমরা স্লোগান দিচ্ছি— বঙ্গবন্ধুর মন্ত্র-বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। ওদিকে যারা ছয় দফার পক্ষে ছিলেন, তারা মুজিববাদের স্লোগান দিতেন।

জাসদ গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এটা তো সবাই জানে যে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ পাল্টাপাল্টি সম্মেলন আহ্বান করলো। বঙ্গবন্ধু গেলেন মণি ভাইদের সম্মেলনে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যদি ওই সম্মেলনে না যেতেন তাহলে জাসদের জন্ম হতো না। চট্টগ্রামে তো আওয়ামী লীগে অনেক গ্রুপ এখন আছে। আ জ ম নাছিরের গ্রুপ আছে, মহিউদ্দিন ভাইয়ের গ্রুপ আছে। কেউ কি বলতে পারবে, শেখ হাসিনা আমার গ্রুপের? এটা তো কেউ বলতে পারবে না। একইরকমভাবে বঙ্গবন্ধুও যদি সেদিন বলতেন— তোদের যা ইচ্ছা তা-ই কর, আমি তোদের সঙ্গে নাই কিংবা তিনি যদি কোনো সম্মেলনে না যেতেন অথবা উভয় সম্মেলনে যেতেন, তাহলে একসময় গিয়ে বিভক্তিটা থাকত না। বঙ্গবন্ধু তো একসময় গিয়ে বাকশালই করেছেন। জাসদের একটা দাবি ছিল— ১২ দফা কি ১৮ দফা। আমরা যারা একসময় জাসদ করেছি, আমরা মনে করি, জাসদের সেই দাবিরই প্রায়োগিক রূপ হচ্ছে বাকশাল।’

‘এককথায় যদি বলি, ছাত্রলীগের একাংশকে জাসদ গঠনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্রলীগে দুই পক্ষ, এক পক্ষ তো আরেকপক্ষের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে পারে না। রাজনীতিতে তো এটা হয় না।’

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে জাসদ গঠনের পর চট্টগ্রামে প্রথমে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন মাহফুজুর রহমান। এরপর সাধারণ সম্পাদক এবং আশির দশকে আ স ম আবদুর রবপন্থী জাসদের চট্টগ্রামের সভাপতি হন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটিতেও ছিলেন তিনি। নেতৃত্বে থাকার পরও মাহফুজুর রহমান মনে করেন, গঠনের পর থেকে জাসদ সারাদেশে হঠকারী রাজনীতি ও অরাজকতার পথ বেছে নিয়েছিল, যার দায় তৎকালীন নেতৃত্ব এড়াতে পারে না।

‘জাসদ শুরুতেই বেশকিছু হঠকারী কাজ করে ফেলে। এর মধ্যে একটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন আক্রমণ। যে কারও বাসভবন আক্রমণ— এটা হঠকারী কাজ। তারপর কিছু কিছু গুপ্তহত্যা জাসদ করেছে, কোনো সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধু তখন অবিসংবাদিত নেতা, কোনো সন্দেহ নেই। জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেকসময় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করেনি, রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছে। এর দায় জাসদ নেতৃত্ব এড়াতে পারবে না এবং ইতিহাস অবশ্যই এর বিচার করবে।’

জাসদ রাজনীতির আরও কিছু ত্রুটি তুলে ধরে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জাসদে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি ছিল, ৮০ ভাগই কিন্তু মাঠপর্যায়ের মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এটাই বাস্তবতা ছিল। এখন একটা কথা আমি বলব, ঠিক হচ্ছে কি না জানি না, বয়স হয়ে গেছে, আমি বলে যাই এটা— জাসদে আর্মিকে নেওয়া খুব ভুল কাজ হয়েছিল। হাজার হাজার নেতাকর্মী কিন্তু এটার বিরোধিতা করেছিল। মেজর জলিল— উনাকে কেন জাসদের সভাপতি করা হলো, উনি তো স্বাধীনতাপন্থী নিউক্লিয়াস থেকে আসা লোক না! কর্নেল তাহেরকে জাসদের সঙ্গে ট্যাগ করা হলো, কেন? কর্নেল তাহের তার ত্যাগের জন্য অসীম শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু উনি অরিজিনালি ছিলেন সিরাজ শিকদারের লোক। জাসদে ঢুকে উনি জাসদকে সিরাজ শিকদারপন্থী করতে চেয়েছিলেন। অস্ত্রের রাজনীতি শুরু করেছিলেন। এর ফলে গোটা জাসদটাই, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা-মেধাবী ছাত্রদের সমন্বয়ে গড়া জাসদটা তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।’

‘কর্নেল তাহেরকে আমি বা আমার মতো অনেকেই জাসদে কোনোভাবেই ওউন করিনি। এই যে জাসদে অস্ত্রের ব্যবহার, এটা কর্নেল তাহেরের হাত দিয়েই হয়েছে। এটা আমরা সিরাজ ভাইকে (সিরাজুল আলম খান) জিজ্ঞাসা করেছিলাম, উনি কোনো জবাব দিতে পারেননি। এখানেই জাসদ রাজনীতির ব্যর্থতা। তোমাকে কে সাতই নভেম্বরের বিপ্লব করতে বলেছে? তুমি আর্মিকে নেতা মেনে বিপ্লব করতে গেলা কেন? যে আর্মি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তোমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, স্বাধীন দেশে এসে জাসদের নেতারা কেন তাদের নেতা মানবে? এতে তো জাসদের গণতান্ত্রিক চরিত্রই আর থাকে না। আবার জাসদ গণবাহিনী কেন করল? এটা ঠিক যে জাসদকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে তুমি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারী একটি বাহিনী গঠন করে যুদ্ধ করবা? এটা তো নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পদ্ধতি হতে পারে না। আমি মূল্যায়ন করি এভাবে— একটা উচ্চাভিলাস কিংবা গোপন কোনো আকাঙ্ক্ষা থেকে তৎকালীন শীর্ষ জাসদ নেতৃত্ব আর্মির সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন। কিন্তু সেটা একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের চরিত্র হতে পারে না।’

জাসদের হঠকারী রাজনীতির বিরোধিতা চট্টগ্রাম থেকে তখনই করা হয়েছিল বলে জানান মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, “আমি বারবার বলি, জাসদ বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছিল। এর বিরোধিতা আমরা চট্টগ্রামের নেতারা করেছিলাম। সাংগঠনিক সভায় দাঁড়িয়ে আমি মেজর জলিলের চোখে চোখ রেখে হুংকার দিয়েছিলাম। চট্টগ্রামে জাসদের ইতিহাসে জাসদের হাতে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা খুন হননি কিংবা আওয়ামী লীগের হাতে কোনো জাসদ নেতা খুন হননি। আমরা (জাসদ) মিছিল বের করার আগে মহিউদ্দিন (এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী) ভাইকে খবর পাঠাতাম, ‘মহিউদ্দিন ভাই, মিছিল হবে, অ্যাটাক করবেন না। সামনে পেছনে মাল (অস্ত্র) আছে।’’

আরও পড়ুন: জাসদ নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় আ.লীগের ওপর বর্তায়: ইনু

জাসদ ছেড়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্রুত ক্ষমতা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। গঠনের দুই-তিন বছর পরই জাসদ তার চরিত্র হারিয়ে ফেলে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এটা একটা স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। রব ভাই (আ স ম আবদুর রব) এরশাদকে সমর্থন দেওয়ার পরই আমি জাসদ ছেড়ে দিই। রব ভাই দেখি এরশাদের সঙ্গে উঠবস করছেন। আমি মনে করি, এই দলে আর থাকা যায় না। আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাই। ১৯৯০ সালে যখন এরশাদের পতন হয়, একেবারে শেষ মুহূর্তে একদিন রব ভাই আমাকে ফোন করে বলেন— মাহফুজ, তুমি এরশাদের পক্ষে চট্টগ্রামে একটা মিছিল করো। আমি বললাম— রব ভাই, আমি তো বিশাল মিছিল এইমাত্র শেষ করলাম এরশাদের পতনের দাবিতে। তাহলে আমরা দেখি— আর্মির সঙ্গে মিলে জাসদ নেতৃত্ব তার চরিত্র হারিয়েছে। হঠকারী কাজের জন্যই কিন্তু জাসদ আজ বিলুপ্ত। আমাদের মতো অনেক নেতাকর্মী পরবর্তী সময়ে আর জাসদ করতে পারিনি।’

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, জাসদ হঠকারী রাজনীতির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জাসদের দায় কতটুকু?— এমন প্রশ্নের জবাব এককথায় না দিলেও হঠকারী রাজনীতির প্রভাবকে পুরোপুরি অস্বীকার করেননি মাহফুজুর রহমান। তবে একইসঙ্গে আরও প্রেক্ষাপট হাজির করেছেন তিনি।

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে গিয়ে জাসদ হঠকারী রাজনীতি করেছে, অরাজকতা করেছে। অবশ্যই করেছে এবং এর দায় জাসদ নেতৃত্বকে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল যে উনি জনগণের দাবি খুব তাড়াতাড়ি মেনে নেন। উনিই একমাত্র নেতা, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উনি জনগণ যা চেয়েছে, তা-ই করেছেন। জনগণের চাহিদা উনার চেয়ে বেশি কেউ বুঝতেন না। সেজন্য আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো একসময় বঙ্গবন্ধু আমাদের পক্ষে আসবেন। তবে জাসদের হঠকারী রাজনীতির মধ্যে আমাদের চাওয়াটা হয়তো সেদিন খুব বেশি দৃশ্যমান আমরা করতে পারিনি। সেজন্য বলছি যে জাসদের ভুল আছে।’

‘কিন্তু শুধুমাত্র অরাজকতা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রের সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পেরেছে— এমন নজির তো নেই। তাহলে তো হেফাজতে ইসলাম যেদিন শাপলা চত্বরে গিয়েছিল, সেদিনই শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়ে যেত। আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জাসদই যে শুধু উগ্র রাজনীতি করেছিল তা নয়, সিরাজ শিকদাররাও তো ছিল। চীনপন্থী বামদের বড় অংশও তো হঠকারী রাজনীতি করেছিল।  জাসদের হঠকারী কাজে আওয়ামী লীগের বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে— এটা আমি মনে করি না।  আওয়ামী লীগকে বিন্দুমাত্র জাসদ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছে— এটা কিন্তু ইতিহাসে নাই। বরং হঠকারী কাজের জন্য জাসদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এটা এখন ইতিহাসের বড় প্রমাণ।’

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জাসদ যেটা চেয়েছিল— গণআন্দোলনের মাধ্যমে হয় বঙ্গবন্ধুকে পক্ষে আনব অথবা উনার পতন ঘটাব। আমি তৎকালীন জাসদ নেতা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে বলছি— জাসদ বঙ্গবন্ধুর পতন চেয়েছিল, হত্যা নয়। কিন্তু জাসদের বড় ভুল ছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখেছিল। বঙ্গবন্ধু যে অবিসংবাদিত নেতা, সেটা তখনকার জাসদ নেতৃত্বের অনেকেই মানতে চাননি। এত বিরোধিতার পরও বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাকে তারা এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। বরং ৭০ শতাংশ মানুষই বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন, জনগণের ভালোবাসায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি জাসদ। জনগণকে টানতে না পেরে আর্মির সঙ্গে জাসদ যুক্ত হয়েছিল কি না, সেটা বিচারের ভার ইতিহাসের ওপর দিলাম।’

সেসময় আওয়ামী লীগ-জাসদ উভয়ই খুনোখুনির রাজনীতি করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-জাসদ সমানে-সমানে খুন করেছে। আওয়ামী লীগ যদি মনে করে তাদের বেশি লোক খুন হয়েছে, সেটা ভুল। আবার জাসদ যদি মনে করে তাদের বেশি লোক খুন হয়েছে, সেটাও ভুল। কত খুন হয়েছিল? সর্বোচ্চ ১০ হাজার। এই পরিমাণ লোক খুন করে বঙ্গবন্ধুর মতো একটা জনপ্রিয় নেতার সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব ছিল না। আবারও বলছি, জাসদের টার্গেট ছিল— আন্দোলন করব। হয়তো বঙ্গবন্ধু পক্ষে আসবেন, না হলে উনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া ছিল। কিন্তু জাসদ প্রক্রিয়াটা দ্রুততর করতে গিয়ে অরাজকতার পথ বেছে নিয়েছিল, এটাও অস্বীকার করা যাবে না।’

বঙ্গবন্ধু জাসদকে কখনো সেভাবে গুরুত্ব দিতেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল, এটা সত্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজেই জাসদের এসব কর্মকাণ্ডকে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শুধু একবার বলেছিলেন, এসব তথাকথিত অস্ত্রধারী বিপ্লবীদের আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত উনি বারবার উনার দলীয় বদমাশ, চোরাকারবারী, মুনাফাখোর, মজুতদারদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার পর যারা দ্রুত ধনী হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে— তখন একই কথা মণি ভাই বলেছেন, নুরে আলম সিদ্দিকী বলেছেন, আব্দুল কুদ্দুস মাখনও বলেছেন। একটা বিষয় হচ্ছে জাসদের বিরুদ্ধে মণি ভাইয়েরা কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। তবে মারামারি হতো। এতে সরকার খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে— এমন কোনো প্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধু যে এতে খুব বিব্রত হতেন কিংবা উনি যে এগুলোকে খুব পাত্তা দিতেন, বিষয়টা এমনও না।’

মাহফুজুর রহমানের মতে, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একাংশের বাড়াবাড়ি, বাঙালি জাতির ওপর বঙ্গবন্ধুর অতি আত্মবিশ্বাস, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং সর্বোপরি বাকশাল গঠনই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কারণ।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট হিসেবে আমি যেহেতু তখন জাসদ করেছি, আমার মূল্যায়নটা হচ্ছে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ একটা কারণ। প্রচণ্ড বন্যা এবং দুর্ভিক্ষে কিন্তু সারা বাংলাদেশে একটা ক্রাইসিস তৈরি হয়ে গেল। কিছু লোক, মজুতদার, চোরাচালানি ও মুনাফাখোরদের অসৎ কর্মকাণ্ড এমন বেড়ে গিয়েছিল যে গুলি করেও থামানো যায়নি। লুটপাট-চুরি ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আওয়ামী লীগে তখন অনেক সৎ রাজনীতিবিদ ছিলেন, তারা ত্যাগী নিঃসন্দেহে। এই বিশাল ত্যাগী নেতৃত্ব থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের একাংশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা চোরাচালানিদের দমন করা যায়নি। যার ফলে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ আসে। তবে দুর্ভিক্ষের পরও যে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা কমেছিল, এটা আমি মনে করি না। সুতরাং জাসদকে দায়ী করা ঠিক না।’

‘বঙ্গবন্ধু বাকশাল করলেন। কিন্তু বাকশালটা ছিল মূলত রাশিয়ান কনসেপ্টের একটা কর্মসূচি। উনি যখন বাকশাল কনসেপ্টে গেলেন, তখন নব্য কোটিপতিদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। বাকশাল কায়েম হলে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যেত। কারণ আমলাদের জনপ্রতিনিধিদের অধীনে নেওয়া হয়েছিল। সামরিক প্রশাসনে সিনিয়র-জুনিয়র একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বেসামরিক প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র করে দেওয়া হলো। এতে চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায় এবং ক্ষোভ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু করেছিলেন সৎ উদ্দেশে, কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হয়। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন বঙ্গবন্ধুকে অজনপ্রিয় করতে চেয়েছে, পারেনি। কারণ তখন বঙ্গবন্ধুর বিকল্প এত জনপ্রিয়, এত উচ্চতার নেতা আর কেউ ছিলেন না। অবশেষে পরিকল্পনা করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে— এটা আমার মূল্যায়ন।’

বাঙালিদের ওপর বঙ্গবন্ধুর অতি আত্মবিশ্বাসের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালিরা সবাই উনার অনুগত থাকবে। সেটা হয়নি। যারা পাকিস্তানের সেবা করেছে ৯ মাস, তারা উনার অনুগত থাকবেন— এটা ভাবাটাই উনার ভুল হয়েছে। ভারত উনাকে খবর দিয়েছে। সম্ভবত সিআইএ খবর দিয়েছে। রাশিয়া আকারে-ইঙ্গিতে বলেছে। সবচেয়ে বড় কথা, কর্নেল তাহের উনাকে খবর দিয়েছিলেন যে ক্যান্টনমেন্টে আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। উনি শুনেছেন, কিন্তু বিশ্বাস করেননি। উনার বিশ্বাস ছিল, কোনো বাঙালি উনাকে মারতে পারবে না।’

‘বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন। উনি ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া— কারও অনুগত ছিলেন না। সবার সহযোগিতা নিয়েছেন, কিন্তু কারও অনুগত হননি। তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি এমন ছিল যে তুমি কারও অনুগত না হয়ে একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে— বিশ্বশক্তি সেটা অ্যালাউ করবে না। উনি কাউকে মানতে চাননি, কারও কাছে নত হননি। আমার মূল্যায়নে উনাকে হত্যার এটাও একটা কারণ।’

    

আওয়ামী লীগের নেতাদের একাংশকে দায়ী করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘জাসদকে যদি দোষারোপ করা হয়, তাহলে বলব— বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় আওয়ামী লীগের একাংশকে অবশ্যই নিতে হবে। এতগুলো এমপি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কেন গেল? তারা পালিয়ে যেতে পারল না? সংসদ খালি থাকত! আমি জাসদ, আমি ভিন্ন রাজনৈতিক দল। আমি তো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলবই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যখন খুন করা হলো, তাহলে দলটির নেতারা কেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় গেল? দোষারোপ থেকে বেরিয়ে এসব বিশ্লেষণ নির্মোহভাবে করা উচিত।’

জাসদ বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর