Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঝুঁকি এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরে দাহ্য-বিস্ফোরক খালাস বন্ধের চিন্তা


১৭ আগস্ট ২০২০ ২১:৫৮

বৈরুত বিস্ফোরণের ঘটনা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরেও বিস্ফোরক খালাস না করার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ

চট্টগ্রাম ব্যুরো: লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ‍উপকণ্ঠে ভয়াবহ জোড়া বিস্ফোরণ কেড়ে নিয়েছে দেড় শতাধিক প্রাণ। আহত হয়েছেন ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ। সে ঘটনায় টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বিপর্যয় এড়াতে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ কনটেইনার থেকে খালাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তারা। চট্টগ্রাম বন্দরের শেডে এ ধরনের দাহ্য ও বিস্ফোরক পদার্থ বা রাসায়নিক কী পরিমাণ আছে, তা জানতে এরই মধ্যে একটি কমিটি করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিদ্যমান আইন যাচাই-বাছাই করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

লেবাননে বিস্ফোরণের পর গত ১০ আগস্ট বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে দেশে সব সমুদ্র, বিমান ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে অননুমোদিত স্থানে বিস্ফোরক, প্রথম শ্রেণির পেট্রোলিয়াম, প্রজ্জ্বলনীয় তরল পদার্থ, প্রজ্জ্বলনীয় কঠিন পদার্থ ও রাসায়নিক পদার্থ মজুত না করার অনুরোধ করে একটি চিঠি দেওয়া হয়।

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। আমরা এটা বলতে চেয়েছি, বিস্ফোরক খালাসের পর সরাসরি মজুতের জন্য চলে যাবে। কোনোভাবেই এটি বন্দরের অভ্যন্তরে কিংবা অননুমোদিত স্থানে আনলোড করা যাবে না। বিস্ফোরক আমদানির প্রয়োজনীয়তা আছে। সেটা তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন এর অপব্যবহার (অ্যাবিউজ) না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’

বিস্ফোরক পরিদফতরের চিঠিতে যেসব পদার্থের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে— ইমালশান সিসমিক, পাওয়ারজেল সিসিমিক, সিসিমিক ডেটোনেটর, চার্জেস ডেটোনেটর, ইলেকট্রিক ডেটোনেটর ও টিএনটি এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট, সালফার, পটাশিয়াম ক্লোরেট এবং ফসফরাসসহ ২১ ধরনের প্রথম শ্রেণির পেট্রোলিয়াম, প্রজ্বলনীয় তরল ও কঠিন পদার্থ।

এই চিঠি পাওয়ার পরই মূলত নড়েচসে বসেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে এর আগেই গত ১৫ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দরের দুই নম্বর জেটি সংলগ্ন তিন নম্বর শেডে আগুন লাগে। ওই অগ্নিকাণ্ডও খালাস না নেওয়ার ফলে মজুত থাকা আমদানি করা রাসায়নিক থেকে সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি এর কোনো সত্যতা পায়নি বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা। সংস্কার কাজের সময় আগুনের স্ফূলিঙ্গ থেকেই এর সূত্রপাত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

বিস্ফোরক পরিদফতরের চিঠির পর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৯ আগস্ট সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর শফিউল বারীকে প্রধান করে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিতে বন্দরের দু’জন পরিচালক (নিরাপত্তা এবং পরিবহন), কাস্টমসের একজন যুগ্ম কমিশনার, পরিবেশ অধিদফতরের একজন প্রতিনিধি এবং কাস্টমসের  রাসায়নিক পরীক্ষককে সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে জানান, কমিটিকে বিস্ফোরক-রাসায়নিক রাখার স্থান ‘পি’ শেডে রাখা কেমিক্যাল ও বিপজ্জনক পণ্যের তালিকা, কতদিন ধরে পণ্যগুলো আছে তার হিসাব, নিলাম বা ধ্বংসযোগ্য পণ্যের তালিকা, এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কী পরিমাণ, এসব পণ্য বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় রাখার জন্য বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত কি না এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো ‍উপাদান আছে কি না— এসব বিষয় খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তারা রাসায়নিক ও ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য হ্যান্ডলিং, সংরক্ষণ ও ডেলিভারির বিষয়ে কাস্টমস, বন্দর, বিস্ফোরক ও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন ও নিয়ম পর্যাপ্ত আছে কি না, তা দেখে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

সচিব জানান, বিদ্যমান রীতি অনুযায়ী বিস্ফোরক ও রাসায়নিকের একাধিক আমদানিকারক একইসঙ্গে একই কনটেইনারে করে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনেন। বন্দরে কনটেইনার খালাসের পর সেগুলো ‘পি-শেডে’ রাখা হয়। এরপর আমদানিকারকরা তাদের সময় অনুযায়ী যার যার পণ্য খালাস করে নিয়ে যান। এতে বন্দরের শেডে প্রায়ই জমা থাকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ।

বৈরুতে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরক পরিদফতরের চিঠি পেয়ে এখন এভাবে বন্দরের অভ্যন্তরে বিস্ফোরক ও রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ মজুত থাকা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। মূলত এই শঙ্কা থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরণ জাতীয় পদার্থ খালাস বন্ধ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (পরিকল্পনা ও প্রশাসন) মো. জাফর আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দরের অভ্যন্তরে কী পরিমাণ উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক আছে, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে তথ্য যে আছে, তাতে বন্দরের শেডে কেনো বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ নেই। এরপর বিস্ফোরক পরিদফতরের একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। এরপর আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছি— বন্দরের অভ্যন্তরে আর কোনো কনটেইনার থেকে দাহ্য পদার্থ ও বিস্ফোরক খালাস করা হবে না। উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক বহনকারী কনটেইনার জেটিতে খালাসের পর সরাসরি চলে যাবে বাইরে। সেখানে আমদানিকারকের নির্ধারিত স্থানে খালাস হবে। তবে কিছু কিছু কেমিক্যাল আছে, যেমন— সোডা অ্যাশ, এসব কেমিক্যাল তো ১০০ বছর পড়ে থাকলেও সমস্যা নেই। কমিটির রিপোর্ট পেলে আমরা এসব বিষয় খতিয়ে দেখব। বন্দরের বিদ্যমান আইন ও বিস্ফোরক আইন, পরিবেশ আইন দেখব। তারপর এই সিদ্ধান্তটা আমরা চূড়ান্তভাবে নেব।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটা পথ বের করার চেষ্টা করছি। তার আগে অবশ্যই আমরা চেম্বার, শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলব।’

বন্দর ও কাস্টমসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৬ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প ও শিল্পকারখানার জন্য প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া নাইট্রেটসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক আমদানি করা হয়েছে।

বিস্ফোরক পরিদফতরের বিধিমালার আওতায় যেসব রাসায়নিক আমদানি হয় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ক্যালসিয়াম কার্বাইড, পটাসিয়াম ক্লোরেট, রেড ফসফরাস, সালফার, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট ও নাইট্রো সেলুলোজ।

আলাদা বিধিমালার আওতায় আমদানি হয় বিস্ফোরক তৈরির উপাদান অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। বিস্ফোরক পরিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, এটি সার হিসেবে, খনিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ফুয়েল বিস্ফোরক তৈরিতে এবং মেডিকেলে নাইট্রাস অক্সাইড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড এবং বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের এই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আমদানির লাইসেন্স রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর পরিবেশ আইন বন্দর আইন বন্দর কর্তৃপক্ষ বিস্ফোরক আইন বিস্ফোরক খালাস বিস্ফোরক পরিদফতর বিস্ফোরক বিধিমালা বিস্ফোরক মজুত বৈরুত বিস্ফোরণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর