ঢাকায় উড়ন্ত সময় ৪৩ মিনিট
১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৩৫
এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : রাজধানী ঢাকায় এখন উড়ে চলার সময় গড়ে ৪৩ মিনিট। এই সময়ে পার হওয়া যায় ২৯ কিলোমিটার পথ। আড়াই কোটি মানুষের বাস যে শহরে, যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে নাকাল হতে হয়, সেখানে এই উড়ন্ত সময়টুকুকে আশীর্বাদ বলেই এখন মনে করছেন নগরবাসী।
এরইমধ্যে ঢাকার মিরপুরে ইসিবি চত্বর থেকে কালশী মোড় পর্যন্ত নতুন একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটির দৈর্ঘ্য হবে ৮৪৪ দশমিক ১২ মিটার। সেই সঙ্গে সড়কও সম্প্রসারণ করা হবে। এতে মিরপুর,পল্লবী, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, মহাখালী ও রামপুরার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে। তাছাড়া সড়কে যানবাহনের ধারণক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় যানজট কমে আসবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফ্লাইওভার নির্মাণে ৬১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা খরচের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরের একটি এই ঢাকা। বিশাল জনগোষ্ঠীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজ করতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তারই এক অন্যতম উদ্যোগ এই উড়াল সড়ক। পথচলায় যা গতি এনেছে সমতলের সড়কগুলো চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
এই গতির কল্যাণে অনেকেই এখন রাজধানীর আশেপাশের শহরগুলোতে বসবাস শুরু করতে পেরেছেন। হাইওয়েগুলোর সঙ্গে মিশে যাওয়া কিংবা প্রায় কাছাকাছি নির্মিত উড়াল সড়কগুলো ব্যবহার করে স্বল্প সময়ে ঢাকায় এসে প্রতিদিন অফিস-আদালত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যসহ প্রয়োজনীয় কাজ সারতে পারছেন একটা বড় সংখ্যক মানুষ।
ঢাকার সড়ক যাতায়াতে গত ১৩ বছরে যোগ হয়েছে মোট সাতটি উড়াল সড়ক। যার মধ্যে বর্তমান সরকারের অধীনে গত সাড়ে ৮ বছরে নির্মিত হয়েছে ৬টি উড়াল সড়ক। মোট ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর উড়াল সড়কগুলো বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা।
https://www.youtube.com/watch?v=xfziT03CTUE&feature=youtu.be
গত ২৬ অক্টোবর সর্বশেষ মগবাজার-মালিবাগ সমন্বিত উড়াল সড়কের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, যানজট নিরসনের জন্য পরিকল্পিতভাবে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। উড়াল সড়ক মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আনবে। এতে সময় বাঁচবে আর বাড়বে কর্মচাঞ্চল্য।
উড়াল সড়কগুলোর নির্মাণ শৈলী নানা ধরনের। নগরীর নানা প্রয়োজনভেদে এগুলোর নকশা ও কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। কোনওটি সমন্বিত, কোনওটি বহুমুখি, কোনওটি সংযোগ এমন নাম পেয়েছে এসব উড়াল সড়ক। এসব সড়কে প্রতিদিন গড়ে কয়েক লাখ যানবাহন চলাচল করছে।
কেবল মগবাজার মালিবাগ উড়াল সড়কেই দিনে ৫০ হাজার গাড়ি চলাচলের হিসাব কষা হয়েছে। উদ্বোধনের দিন সেকথা জানিয়েছিলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
সড়ক যাতায়াত বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে জানান, ঢাকার ৭টি উড়াল সড়ক দিয়ে প্রতিদিন কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো জরিপ বা গবেষণা হয়নি। তবে প্রতিদিন গড়ে কয়েক লাখ গাড়ি চলাচল করার কথা।
তিনি আরো জানান, উড়াল সড়ক দিয়ে অফ আওয়ারে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করে। পিক আওয়ারে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবে এই বিষয়েও এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। অন্যদিকে, ঢাকায় সরকারিভাবে গাড়ি চলাচলের গড় গতি হচ্ছে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবে পিক আওয়ারে ঘণ্টায় ৪ কিলোমিটারের কিছু বেশি গতির বাইরে গাড়ি চলাচল করতে পারে না।
সরকারিভাবে ঢাকায় চলাচলের গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। এই হিসেবে ২৯ কিলোমিটার উড়াল সড়ক পাড়ি দেয়ার গড় সময় হচ্ছে ৪৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ড।
বেসরকারি চাকরিজীবী মেসবাহ শিমুল প্রতিদিন পূর্ব প্রান্ত সাইনবোর্ড থেকে ঢাকার কেন্দ্রে এসে কাজ করেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘উড়াল সড়কের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে। প্রতিদিন ৩০ মিনিটের মধ্যেই অফিসে হাজির হতে পারি। মেয়র হানিফ উড়াল সড়কের যাত্রাবাড়ী প্রান্ত দিয়ে গুলিস্তান আসতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট।’
ফকিরের পুলের বাসিন্দা আহমদ আতিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্যামলীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতে আগে অনেক সময় লাগত। উড়াল সড়কের কারণে এক তৃতীয়াংশ সময় এখন কম লাগে। ফকিরের পুলের বাসা থেকে বের হয়ে মগবাজার-সাতরাস্তা এবং সাতরাস্তা-বিজয় সরণি উড়াল সড়ক ব্যবহার করে যাতায়াতে গতি পাওয়া যাচ্ছে।’
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘অসহনীয় পর্যায়ের যানজট মোকাবেলা করতেই উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সড়ক নির্ভর। নদী ব্যবস্থাপনায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই যানজট কমাতে পরিকল্পিতভাবে উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।’
যাতায়াতে উড়াল সড়কের গতি প্রসঙ্গে ড. শামসুল আলম বলেন, ‘উড়াল সড়ক আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অনেক সহজ করেছে। চট্টগ্রাম, সিলেট বা কুমিল্লা যেতে মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক ব্যবহার করলে অনেক দ্রুত গতিতে যাওয়া যায়। অথচ এক সময় এই পথে শুধু যাত্রাবাড়িতেই দেড় ঘণ্টা সময় খরচ হতো। কুড়িল উড়াল সড়ক ব্যবহার করে বনানী থেকে ১০ বা ১৫ মিনিটেই ৩০০ ফিটের রাস্তায় নামা যায়। যাতায়াত ব্যবস্থায় এই মাধ্যম অনেক সময় বাঁচিয়ে কাজের গতি বাড়াচ্ছে। আবার ফার্মগেট থেকে উড়াল সড়ক ব্যবহার করে বিমানবন্দর এলাকায় যেতে এখন লাগে ৪০ মিনিট। যা আগে দেড় থকে ২ ঘণ্টা লাগত।’
পরিকল্পনা কমিশনের এই সদস্য আরো বলেন, ‘উড়াল সড়ক সবার জন্য নয়। যারা দ্রুত যেতে চায়, পয়সা দিয়ে যেতে চায় উড়াল সড়ক তাদের জন্য। উড়াল সড়কের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক সহজ হয়েছে। তবে প্রতিদিনই যানের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এখনো যানজট আছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় আরো দীর্ঘতম উড়াল সড়ক, আকাশ রেল, পাতাল রেল, মেট্রো রেলসহ আরো কয়েকটি মাধ্যম যোগ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন যানজট সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে।’
ঢাকার ৭ টি উড়াল সড়ক
রাজধানী ঢাকার উড়াল সড়কগুলো হচ্ছে, মগবাজার-মালিবাগ সমন্বিত উড়াল সড়ক, জিল্লুর রহমান উড়াল সড়ক (বনানী-বিমানবন্দর), মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক, কুড়িল উড়াল সড়ক, বিজয় সরণি উড়াল সড়ক, খিলগাও উড়াল সড়ক এবং মহাখালি উড়াল সড়ক।
মগবাজার-মালিবাগ সমন্বিত উড়াল সড়ক
৮ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এই উড়াল সড়কটি চলতি বছরের ২৬ অক্টোবর যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ব্যস্ততম ৭ টি মোড়ের ওপর দিয়ে এই উড়াল সড়ক নির্মাণ করে যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজ করা হয়েছে। যানজটক এড়াতে শান্তিনগর, মালিবাগ, রামপুরা, ওয়্যারলেস, মগবাজার, এফডিসি এবং সাতরাস্তা এই মোড়গুলোর ওপর দিয়ে চলে গেছে উড়াল সড়ক। এই উড়াল সড়কটি মূলত ৩ অংশে বিভক্ত। একটি অংশ ইস্কাটন থেকে মগবাজারের ওপর দিয়ে মৌচাক-মালিবাগ পর্যন্ত। আরেকটি শান্তিনগর থেকে মালিবাগ হয়ে সরাসরি বাংলামোটর এবং মালিবাগ থেকে রামপুরা পর্যন্ত। অন্য অংশটি হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে মগবাজারের ওপর দিয়ে সরাসরি সাতরাস্তা এবং কারওয়ান বাজার পর্যন্ত।
জিল্লুর রহমান উড়াল সড়ক (বনানী-বিমানবন্দর)
নির্ধারিত সময়ের ৩ মাস আগে ২০১৩ সালের ২৭ মার্চ শহরবাসীর চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় জিল্লুর রহমান উড়াল সড়ক। ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এই সড়কটি উদ্বোধনের পর মিরপুর ও গাবতলী এলাকার লোকজনের ক্ষেত্রে উত্তরা, বিমানবন্দর, টঙ্গি পথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হয়েছে। এই সড়ক উদ্বোধনের আগে মিরপুর ও গাবতলী এলাকার লোকজন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে বিমানবন্দর যেতে পাড়ি দিতে হত দীর্ঘ ১১ কিলোমিটার। উড়াল সড়কের ফলে এখন ১১ কিলোমিটারের বদলে পাড়ি দিতে হয় মাত্র ৩ কিলোমিটার।
মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক
২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক উদ্বোধন করা হয়। দেশের বৃহত্তম এই উড়াল সড়ক ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩০ টি জেলার যোগাযোগকে সহজ এবং গতিময় করেছে। চারলেনের এই উড়াল সড়কে ওঠা-নামার পথ রয়েছে ১৩ টি (৬ টি প্রবেশ এবং ৭ টি বের হওয়ার পথ)। সড়কটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। উড়াল সড়কটি শনির-আখড়া, ধোলাইপাড়, যাত্রবাড়ি, সায়দাবাদ, গুলিস্তান হয়ে নিমতলীতে গিয়ে নেমেছে।
কুড়িল উড়াল সড়ক
ঢাকার ৭টি উড়াল সড়কের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হচ্ছে কুড়িল উড়াল সড়ক। এই সড়কের সৌন্দর্যের আকর্শনে প্রতিদিনই স্থানীয় বাসিন্দাসহ আশেপাশের মানুষ বেড়াতে আসেন। ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর সড়কটিতে বনানী, কুড়িল, খিলক্ষেত এবং পূর্বাচল এই ৪ টি লুপ দিয়ে উঠা-নামা করা যায়। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট কুড়িল উড়াল সড়ক উদ্বোধন করা হয়।
বিজয় সরণি উড়াল সড়ক
বহুল আলোচিত র্যাংগস ভবন ভাঙার মধ্য দিয়ে সূচিত হয় বিজয় সরণি উড়াল সড়ক নির্মাণ কাজ। ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়কটির উদ্বোধন করেন। প্রায় ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর এই সড়কটি মিরপুর, শেরেবাংলা নগর ও ধানমণ্ডি অঞ্চলের লোকজন তেজগাও, উত্তরা, মহাখালী ও বিমারবন্দর যেতে ব্যবহার করছেন। উড়াল সড়কটি তেজগাও রেলক্রসিং এর যানজট কমাতে এবং ঢাকার পূর্ব প্রান্তকে কেন্দ্রের সঙ্গে যাতায়াতে সহজ করেছে।
খিলগাঁও উড়াল সড়ক
১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর খিলগাঁও উড়াল সড়কটি ২০০৫ সালে উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ১৬ জুন ৬২০ মিটার দৈর্ঘ্যরে খিলগাঁও উড়াল সড়ক লুপ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সড়কটি রাজারবাগ, মালিবাগ, সায়দাবাদ, মাদারটেক, বাসাবো, কদমতলী ও সিপাহীবাগের মধ্যে যোগাযোগকে সহজ করেছে। অন্যতম ব্যস্ত এই সড়ক খিলগাও রেলক্রসিং এর যানজট কমিয়ে মানুষের চলাচলে গতি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
মহাখালী উড়াল সড়ক
চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া ঢাকার প্রথম উড়াল সড়ক হচ্ছে মহাখালি উড়াল সড়ক। ১ দশমিক ১২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যর উড়াল সড়কটি ২০০৪ সালের ৪ নভেম্বর যাতায়াতের জন্য খুলে দেয়া হয়। মহাখালি রেলক্রসিং এর যানজট কমাতে ব্যবহৃত হচ্ছে উড়াল সড়কটি।
সারাবাংলা/জেআইএল/একে