গ্রেনেড হামলায় শ্রবণশক্তির ক্ষত বয়ে চলছেন শেখ হাসিনা
২১ আগস্ট ২০২০ ০০:৩১
ঢাকা: আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে মূল লক্ষ্য করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্বর-নৃশংস ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ঘটে। সেদিন তার ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ভয়াবহ প্রাণঘাতি হামলা সংঘটিত হয়। সেদিন উপস্থিতি নেতাকর্মীরা মানবঢাল সৃষ্টি করে দলীয় সভাপতিকে প্রাণে রক্ষা করেন। সেই গ্রেনেড হামলার আঘাত বয়ে নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ পরিচালনা করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নৃশংসভাবে সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্বভার নিয়ে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দেশে ফেরার পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী, জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে বারবার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তার সরকারের আমলেও তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এরপর তাকে বহনকারী বিমানে দুবার নাশকতার চেষ্টা হিসেবে তাকে হত্যার চেষ্টা করাসহ মোট ২১ বার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে হামলা সংঘটিত হয়।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘এই মাসেই ১৫ আগস্ট যেহেতু বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেদিন দেশের বাইরে ছিল। তাই হত্যাকারী সেদিন তাদের হত্যা করতে পারেনি বলেই তাদের সেই অসমাপ্ত কাজ পূর্ণ করবার লক্ষ্যেই বারবার চেষ্টা করেছে, আমাদের মাননীয় নেত্রী আজকের প্রধামন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রাণনাশ করার। ২১ শে আগস্ট হচ্ছে আরেকটি কালো দিন।’
সেদিনের সেই সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে আমু বলেন, ‘এই যে হত্যাকাণ্ড এবং সন্ত্রাস নৈরাজ্য এর বিরুদ্ধে সেদিন প্রতিবাদ সভা ছিল আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। এই প্রতিবাদ সভাটা হওয়ার কথা ছিল মুক্তাঙ্গণে। মুক্তাঙ্গনে যখন মাইক টাঙাতে বাধা দেওয়া হলো, পুলিশ এসে বাধা দিল, মাইক ছিনিয়ে নেওয়া হলো। আমরা বাধ্য হয়ে মুক্তাঙ্গন ছেড়ে আমাদের অফিসের সামনে এসে ট্রাকে মাইক বেঁধে মিটিং শুরু করি এবং মিটিং শুরু হওয়ার পর একে একে আমরা বক্তব্য দেই। তারপর সর্বশেষ মোহাম্মদ হানিফ যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন হানিফের বক্তব্য শেষ; ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের মাননীয় আজকের প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা মঞ্চে উঠে বললেন, পথে পথে এত ভিড়, আমরাও দেখছি, এত লোক আসছে মিছিল করে, এতে গাড়ি চালানো সম্ভব ছিল না।
‘তারপর উনি বক্তব্য দিতে শুরু করেন। উনি বক্তব্য শেষ করে যখন নামছিলেন, ঠিক তখন লক্ষ্য করেই গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়, ব্রাশফায়ার করা হয়, আমরা তখন তাকে নিয়ে পড়ে গেলাম। পরবর্তীতে তাকে নামিয়ে দেওয়া হলো। তিনি যখন গাড়িতে উঠবেন, তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। এমনিভাবে দুই-তিনবার তার উপরে এটেম্পড নেওয়া হয়। ওনি চলে যাওয়ার পরপরও দুই বার সেই গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছে। ট্রাকের নিচে যে গ্রেনেডটি ছিল আল্লাহর অসীম রহমত, ওই গ্রেনেডটি যদি বিস্ফোরিত হত, তাহলে শেখ হাসিনার সঙ্গে আমাদেরও প্রাণনাশ হতো।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে এবং পরবর্তীকালে জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে হত্যা করেছিল আওয়ামী লীগকে শেষ করার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সমস্ত নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য। ঠিক তেমনি ২১ শে আগস্টও তারা সেই পরিকল্পিতভাবেই এগিয়েছিল। শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের যদি প্রাণনাশ করা যায় তাহলে আবার আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার সম্ভব হবে। কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমত, সেদিন আল্লাহতালা নিজের হাতেই শেখ হাসিনাকে রেখেছিলেন। সেদিন তার বাঁচার কথা ছিল না। আজকে তিনি বেঁচে আছেন বলেই মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আমরা লক্ষ্য কোটিবার শুকরিয়া আদায় করি।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করে আমু বলেন, ‘মহান রাব্বুল আলামিন তাকে বারবার বাঁচিয়েছেন। ১৯বার তার প্রাণনাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবারে মহান রাব্বুল আলামিন তাকে নিজেই বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং আমরা বুঝতে পারি, শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখার কারণেই হচ্ছে বাংলার ১৬ কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা। বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নের সিঁড়িতে নিয়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু যেটা চেয়েছিলেন, একটা সমৃদ্ধশালী মর্যাদাশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করুক। আজকে শেখ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেটা করা সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করি যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ, বাংলাদেশ ওলি আউলিয়ার দেশ, তাই মহান রাব্বুল আলামিনের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে বলেই আজকে শেখ হাসিনা নেতৃত্বে মানবকল্যাণেই আল্লাহতালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর সেদিন সুধাসদনে ছুটে গিয়েছিলেন ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। তিনি জানান, ওনার একটি ছবি আছে, যেটাতে ঠোঁটের ওটার হাত চেপে ধরে রাখা। একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা-মা-বাবা মারা গেলে যেমন একটা চেহারা হয়, সেরকম একটা চেহারা। দৃষ্টিশূন্য মেলে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যখন সুধাসদনে ঢুকলাম, ঠিক ওই দৃশ্যটাই দেখতে পেলাম। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আমার চিকিৎসার দরকার নেই। আমার কিছু হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাও। তোমরা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে যাও।’ কথাগুলো সারাবাংলাকে বলছিলেন চিকিৎসক অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত।
তিনি বলছিলেন সেই দিনটির কথা, ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার কথা। অধ্যাপক প্রাণ গোপাল বলেন, ‘আমাকে ডাকা হয়েছিল সুধাসদন থেকেই। আমি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যলয়ে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম। তখনও আমি জানি না যে গ্রেনেড হামলাটা হয়েছে।’
সেদিন বর্বর জঘন্য রাজনৈতিক সহিংসতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংঘটিত হয়। যে হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার ডান কানের শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে প্রাণগোপাল বলেন, ‘নেত্রীর নির্দেশে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানলাম, একটি ওটিতে আইভি রহমানকে রাখা হয়েছে। তার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। রিপেয়ার করার মতো কেউ নাই। আমি দ্রুত ঢুকলাম। ডা. রোকেয়া ও অ্যানেসথেশিয়ার একজন চিকিৎসক রয়েছেন। ততক্ষণে ওনার চোখ ফিক্সড হয়ে গেছে। অর্থাৎ বলা যায়, উনি ক্লিনিক্যালি ডেড হয়ে গেছেন। সে অবস্থাতেই তার চিকিৎসার সব ধরনের চেষ্টা চালালাম। এরপর একের পর এক অন্য যে আহতদের আনা হলো, তাদেরও দেখলাম।’
বর্বর, নৃশংস ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। গুরুতর আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। রক্তে রঞ্জিত আর হতাহতদের অসহায় আর্তনাদে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দিনটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্য এক গভীর বেদনার দিন। সেদিন মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আওয়ামী লীগ সভাপতির দু’টি কানের শ্রবণশক্তি।।
এ বিষয়ে প্রাণ গোপাল বলেন, ‘একটি কানের শ্রবণ শক্তি আমাদের পক্ষে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। অন্য কানে তিনি শুনতে পান। ওনার ডান কানের সেন্সরি নিউরাল হিয়ারিং লস্ট অর্থ্যাৎ স্নায়ু নষ্টজনিত বা স্নায়ুবিক আঘাতের জন্য কানের শ্রবণশক্তি অনেকটা কমে যায়। এটা অতি মাত্রায় শব্দ দূষণের ফলেই হয়। যেটা হয়েছে গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ থেকে।’
প্রাণ গোপাল বলেন, ‘যেহেতু উনি (শেখ হাসিনা) যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে বাইরে যাননি, তাই আমরাও যখন চিকিৎসা দিলাম, উনি সেটা ঠিকমতো নিতে পারেননি। কারণ ওই হামলায় এত হতাহতের ঘটনা ঘটে যে তাদের সেবা শুশ্রুষা করার জন্যই উনি পাগল হয়ে গেলেন। এতে ক্ষতিটা বেড়েই গেল।’
তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার পরে উনি নিজের জন্য বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি। ঘটনার দুই দিন পর আমাকে বললেন, ‘কানের ভিতরে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে, কানে শুনছেন না। মাথা ঝিমঝিম করছে। অথচ প্রথম দিন উনি আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। নিজে এরকম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না।’
‘তারপরও আমরা যতই বলেছি যে, হাইপারবারিক অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট আছে বিদেশে, সেটা করলে হয়তো একটু ভালো হবে; কিন্তু উনি চিকিৎসা নিতে যেতে চাইলেন না। বললেন, আমি এদের ফেলে কোনোদিনও চিকিৎসা নিতে যাব না।’
‘তারপরে উনি যখন সিঙ্গাপুরে গেলেন, সেখানে পরীক্ষা করা হলো। আমি বাংলাদেশে যে পরীক্ষা করে যে ডায়াগনসিস লিখেছিলাম, যে পরিমাণ শ্রবণশক্তি লস্ট ছিল সিঙ্গাপুরেও সেইটাই কনফার্মড করা হলো। তখন সিঙ্গাপুর থেকেই ওনাকে ফাইনালি বলে দেওয়া হলো ডান কানে শুনতে কানের যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।’
এভাবেই সেই বর্বর জঘন্য ঘৃণ্যতার গ্রেনেড হামলার আঘাত আজও বয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ পরিচালনা করছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমার নেতাকর্মীরা সবাই আমাকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে অনেকেই ইনজিউরড (আহত) হয়েছে। তাদের রক্ত এখনও আমার কাপড়ে লেগে আছে। আমার নেতাকর্মীরা তাদের জীবন দিয়েই আমাকে বাঁচিয়েছে।’