‘রাজনীতি করি মানুষের জন্য, আগে মানুষগুলোকে বাঁচাও’
২৩ আগস্ট ২০২০ ০১:৫৭
ঢাকা: ‘নেত্রী আমরা সারা বাংলাদেশ বন্ধ করে দেবো, এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য আমরা হরতাল করব। সেদিন নেত্রী বলেছিলেন, নানক, আমার জন্য আর কত মানুষ মারা যাবে! আমার আর ভালো লাগে না। আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। তোমরা আগে মানুষগুলোকে বাঁচাও, চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আমার দুই বোনের যা কিছু আছে সব বিক্রি করে হলেও চিকিৎসা করতে হবে, একটি মানুষও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’— ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন দলের বর্তমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবীর নানক।
শনিবার (২২ আগস্ট) রাতে মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় অংশ নিয়ে ২১শে আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। ‘২১শে আগস্ট: রাজনীতিতে এক জঘন্য অধ্যায়’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ।
মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ করার কর্মসূচি পূর্বনির্ধারিত ছিল উল্লেখ করে নানক বলেন, ‘কিন্তু সরকার মুক্তাঙ্গনের সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কোনো মঞ্চ তৈরি করতে না দেওয়ায় একটি ট্রাক ভাড়া করে অস্থায়ী মঞ্চ করা হয়। যখন ওই জায়গায় নেত্রী শেখ হাসিনা কোনো কর্মসূচি করেন তখন আমরা কিন্তু যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে পার্শ্ববর্তী দালানের ছাদ ও ফ্লোরে পাহারা বসাই। কিন্তু সেদিন পুলিশ আমাদের কাউকে উঠতে দেয়নি। কোনো পাহারা আমাদের দিতে দেয়নি। সেকারণে আমাদের মধ্যে একটা সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তারপর হঠাৎ করেই যখন মেজর ইকবাল সুধা সদন থেকে ফোন করে জানালেন যে, নেত্রী পাঁচ মিনিটের মধ্যে রওনা করছেন। তখন আমরা যুবলীগ অফিস থেকে নেমে যুবলীগের সব নেতাকর্মীদের নিয়ে আমি ও মির্জা আজম নূর হোসেন পয়েন্ট (জিরো পয়েন্ট) অতিক্রম করে আরও বেশ দূরে এগিয়ে গেলাম এবং নেত্রীর গাড়িকে এসকর্ট করে আনলাম।’
সেদিন অস্থায়ী মঞ্চটি ঘিরে মহিলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নেত্রীর ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো এক এক করে। সেগুলো ছিল পাকিস্তানের তৈরি আর্জেস গ্রেনেড। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন জঘন্য আক্রমণ হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে নেই দলীয় নেতাকে রক্ষার জন্য জাতীয় নেতারা মানবঢাল তৈরি করে।’
তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত চার দলীয় জোট সরকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার গ্রেনেড হামলা সংঘটিত হয়েছিল দাবি করে নানন বলেন, ‘নেত্রীর নিশ্চিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে চেয়েছিল সেদিনের খালেদা-তারেক-নিজামী। নেত্রীর গাড়ির চাকা পাংচার করে দেওয়া হয়েছে। তারপর নেত্রী যখন সেই গাড়িতে উঠলেন সেই গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়।’
আহত নেতাকর্মীদের উদ্ধারের সময় পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমাদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসার কথা পুলিশবাহিনীর। যে পুলিশবাহিনী সেদিন সারাক্ষণ দেখলাম না, সারাদিন দেখলাম না, সেই পুলিশের দুটি দল দুই পাশ দিয়ে এসে বেপরোয়া টিয়ার গ্যাস এবং লাঠিপেটা শুরু করল আমাদের। এ থেকেই প্রমাণ হয়, যে ঘাতকেরা গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল, তাদের এই এলাকা থেকে চলে যাওয়াকে নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে এবং বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে।’
নানক বলেন, ‘পরে আমরা সুধাসদনে গিয়ে পৌঁছে দেখি, নিচের ড্রয়িং রুমে একটি সোফার মধ্যে নেত্রী বসে আছেন। তার পাশে হাতলের উপরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা আপা তার গলা জড়িয়ে ধরে বসে। তিনি নির্বাক ও হতভম্ব হয়ে বসে আছেন। আমরা তখন ক্ষোভে বলতে লাগলাম, নেত্রী আমরা সারা বাংলাদেশ বন্ধ করে দেবো, এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য আমরা হরতাল করব। জানেন, জনতার নেত্রী, কর্মীবান্ধব নেত্রী সেদিন বলেছিলেন? নানক, আমার জন্য আর কত মানুষ মারা যাবে। আমার আর ভালো লাগে না। আমি রাজনীতি করি মানুষের জন্য। তোমরা আগে মানুষগুলোকে বাঁচাও, চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। আমার দুই বোনের যা কিছু আছে সব বিক্রি করে হলেও চিকিৎসা করতে হবে। একটি মানুষ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়।’
‘ওইদিন রাত ১২টার দিকে যখন নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম সুধাসদনে। তখন নেত্রী আমাদের একটি নির্দেশনা দিলেন। সেই নির্দেশনা ছিল- ওই বিধস্ত এলাকাটিকে ঘিরে তোমরা কর্ডন করে রাখো, যাতে আলামত নষ্ট না হয়। আমরা গিয়ে যুবলীগ অফিসে থাকা লাল ব্যানার ছিঁড়ে ফিতা বানিয়ে সমগ্র এলাকাটিতে লাল ফিতা টাঙিয়ে দিলাম এবং যেখানে যেখানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়েছে সেই জায়গাগুলোতে কালো নিশান, কোনো জায়গায় লাল নিশান টাঙিয়ে দিলাম। কিন্তু দুঃখজনক, ওই জালেম সরকার, নমরুদ সরকার, এই খালেদা-নিজামী সরকার রাতের বেলা সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসকে দিয়ে সব ধুয়ে মুছে পরিষ্কার নিয়ে যায়। এমনকি অস্থায়ী মঞ্চ বানানো ট্রাকটিও তারা সরিয়ে নিয়ে লোমহর্ষক ওই ঘটনার আলামত নষ্ট করে’— বলেন জাহাঙ্গীর কবীর নানক।
তিনি আরও বলেন, ‘কি ন্যাক্কারজনক, দুভ্যার্গজনক, কি কষ্টকর ঘটনা। পরের দিন পার্লামেন্ট অধিবেশনে যখন নেত্রী কথা বলতে চাইলেন সংসদে, সেই মহান সংসদে নেত্রীকে কথা বলতে দিলেন না। আমাদের এমপিদের কথা বলতে দিলেন না। এই খালেদা জিয়া এক স্বৈরাচারী মহিলা। নেত্রীকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।’
নানক বলেন, ‘খালেদা জিয়া ১৫ আগস্টে কেক কেটে আনন্দ উৎসব করেন। এভাবে তিনি পাকিস্তানকে খুশি করেন। সেদিন পাকিস্তানি গোয়েন্দা আইএসআইর সঙ্গে যোগসাজেশ করে হামলা পরিচালনা করেছিল তারেক রহমান।’
২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে বিচার হয়েছে সেই বিচারের রায় অনতিবিলম্বে কার্যকর চাই। কার্যকর চাই এইভাবে যে, খালেদা জিয়াও অভিযুক্ত হবেন এবং তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হোক।’
২১ শে আগস্ট আওয়ামী লীগ গ্রেনেড হামলা জাহাঙ্গীর কবীর নানক মানুষ রাজনীতি শেখ হাসিনা