‘মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ধ্বংস করতেই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটায় বিএনপি’
২৫ আগস্ট ২০২০ ০২:৫৫
ঢাকা: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বুকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশে চালানো হয় নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞ। গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ও প্রধান টার্গেট ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়োজিত সমাবেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এসে সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই ঘটনায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের আঘাতে আইভি রহমানসহ মোট ২৩ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ছিল সেই হামলায়। ওই সময়ই বিএনপি জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটনায় দেশে। তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরব, তা ধ্বংস করে দেওয়া।
২১ আগস্ট উপলক্ষ্যে সোমবার (২৪ আগস্ট) রাত সাড়ে ৮টায় আওয়ামী লীগের আয়োজনে ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও রাষ্ট্রীয় মদতে জঙ্গিবাদের উত্থান’ শীর্ষক বিশেষ ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে ওয়েবিনারটি সরসারি প্রচার করা হয়।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তবে দেখা যায় তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে, তাদের ছত্রছায়ায় এই ঘটনাটি সংগঠিত হয়েছে। আমাদের মুক্তাঙ্গনে সমাবেশের কথা থাকলেও পুলিশের বাধার মুখে সরে গিয়ে অস্থায়ী মঞ্চ করে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে বাধ্য হই। মুক্তাঙ্গনে এমন হামলা করা সম্ভব নয় বলে আমাদের সরিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে নিয়ে আসা হয়, যেন ওদের পরিকল্পনা সফল করতে পারে। গ্রেনেড হামলার পর পরই টিয়ার গ্যাস ও গুলি করে নেতাকর্মীদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং যারা হামলার সঙ্গে জড়িত, তারা যেন নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতেই পুলিশ বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে। এরপর ফায়ার ব্রিগেড ডেকে পানি দিয়ে পুরো এলাকা ধুয়ে আলামত নষ্ট করে ফেলে। আমাদের আহত নেতাকর্মীদের সাহায্য সহযোগিতা না করে প্রশাসন উলটো আমাদের ওপর হামলা করলো। নামমাত্র একটা তদন্ত কমিটি গঠন, জজ মিয়া নাটক সাজানো, এমনকি সংসদ চলাকালীন সময়ে এমন ঘটনা ঘটলেও সংসদে এই ব্যাপারে আলোচনা করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। কেন এমনটা করেছিল তৎকালীন জোট সরকার— প্রশ্ন রাখেন বর্ষীয়ন এই রাজনীতিবিদ।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের চেষ্টার শুরুটা ১৫ আগস্ট থেকে। বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা, জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা, বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবেশ, একটি নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুটা সেই ১৫ আগস্ট। তারই ধারাবাহিকতায় ১৫ আগস্টে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালায় সেই পুরানো একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, সেদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ক্ষমতার আরেক কেন্দ্রবিন্দু ছিল হাওয়া ভবন, যা পরিচালনা করতো খালেদা জিয়ার কু-পুত্র তারেক রহমান। ওই সময় ধাপে ধাপে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার, সেদিন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন নাশের উদ্দেশ্যে বাড়িঘরে আগুন দেয়, ধর্ষণ করে, চিরদিনের জন্য আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংককে ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদ।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু যখন ধংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেশ নির্মাণের দিকে মনযোগ দিলেন, ঠিক তখনই একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা ষড়যন্ত্র শুরু করলো। এই শক্তি কখনো বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বারবার ষড়যন্ত্র করে গেছে। সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস লালনের শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়, জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৭৯ সালে পার্লামেন্টে সেটাকে আইনে রূপান্তর করে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শুরুটা জিয়া পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান, যার প্রমাণ ১৯৯১-১৯৯৬ পর্যন্ত তার স্ত্রী বেগম জিয়ার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং ২০০১-২০০৬ ক্ষমতায় থাকাকালীন তার কু-পুত্র তারেক রহমানের জঙ্গিদের লাললনপালন ও আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
তিনি আরও বলেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা যে রাষ্ট্রীয় মদতে হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার অনুমোদনে এবং তারেক রহমানের পরিচালনায় যে গ্রেনেড হামলা হয়েছে— এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বেগম খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায়, তখন জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের উত্থান হয়েছে, বাংলা ভাইয়ের উত্থান হয়েছে, ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা হয়েছে, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলাও এই খালেদা জিয়ার আমলেই হয়েছে। সব দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যখনই জিয়া পরিবার ক্ষমতায় এসেছে তখনই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসের লালন-পালন হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিল, স্বাধীনতাকে হত্যা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করেছিল। ওরা মনে করেছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করবে, গণতন্ত্রকে হত্যা করবে। কিন্ত আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনা আজ বেঁচে আছেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
আলোচনায় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘সেদিন খালেদা জিয়া এই হামলার মাধ্যওমও তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারেন নাই। তখন তারা আসলে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার নৈপথ্য হলো জনগণ দিয়ে ক্ষমতাই থাকার তাদের কোনো সুযোগ নেই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এবং দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এই ধরনের জঙ্গিবাদ উত্থানের মধ্য দিয়ে তারা কেবল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা চালিয়েছেন।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম বলেন, ‘১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্ট একই সূত্রে গাঁথা। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা সম্পর্কে বলা যাবে না। তারা মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই এ দেশে আর কোনো মানুষ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে না, কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি। যখন তারা দেখল তাদের এই আশা পূরণ হবে না, তখন তারা বঙ্গবন্ধুর সীপাহশালার ৪ জনকে জেলখানায় হত্যা করে। তাদের হত্যা করার একটাই কারণ ছিল— বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তারা স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন, এরা যদি বেঁচে থাকেন, হয়তো বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা আবার গর্জে উঠবে। তারপরে এখানেও যখন তারা সফল হলো না, তখন তারা বেছে নিলো বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার গায়ে প্রবাহিত, তাদের যদি শেষ করতে না পারি তাহলে তাদের ইচ্ছা পূরণ হবে না। এজন্যই বঙ্গবন্ধুকন্যাকে মোট ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।’
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষী মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) বলেন, ২১ আগস্টে রাতে ঘটনাস্থলে যে গ্রেনেড দু’টি পেয়েছি, হুবহু সেইম গ্রেনেড পরের দিন গোলাপ শাহ মাজারের পাশে এবং জেলখানার পাশে আর একটি গ্রেনেড আমি পেয়েছিলাম। ২১ আগস্ট পাওয়া গ্রেনেড দু’টি ধ্বংস করে দেওয়ার নির্দেশ ছিল আমার কাছে। কিন্তু আমি গ্রেনেডগুলো আমাদের ব্রিগেডে নিয়ে আসি। অনেক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আসে গ্রেনেডগুলো নেড়েচেড়ে দেখে তারাও রায় দেয় যে, এগুলো যুদ্ধে ব্যবহার করে এমন গ্রেনেড। সেদিন বিকেলে সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা এসে গ্রেনেড দুটো নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমার বাড়িতে প্রশাসনের লোকজন গেল, আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্য করে অবসর নিতে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় আমি আমার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একজন সাক্ষী হিসেবে রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়ালাম।
আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আশরাফুল আলম খোকন বলেন, ‘এরকম ন্যাক্কারজনক ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর নেই। একটা রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ রাষ্ট্রীয় মদতে ২১ আগস্টে করা হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ মদতে ওই সময় জঙ্গিদের লালন-পালন করা হয়েছে বাংলাদেশকে জঙ্গিদের চারণভূমি করার জন্য এবং সেই প্রচেষ্টা এখন অনেকটাই ব্যর্থ।’
আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল ছাড়াও অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারিত হয় সারাবাংলা ডটনেট, বিজয় টিভির পর্দায়, সময় টিভি, বিডিনিউজ২৪, বাংলা নিউজ২৪, বার্তা২৪, সমকাল, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ভোরের কাগজ, ঢাকা টাইমস২৪, জাগো নিউজ২৪ ও বাংলাদেশ জার্নালের ফেসবুক পাতায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়।
২১ আগস্ট আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগ আমির হোসেন আমু আশরাফুল আলম খোকন এস এম কামাল ওয়েবিনার গ্রেনেড হামলা ড. হাছান মাহমুদ নজরুল ইসলাম বাবু মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া