এসডিজি’র ৬ লক্ষ্যে অগ্রগতি, ৬ খাতে ‘দৃশ্যমান’ সাফল্য
২৬ আগস্ট ২০২০ ১১:১০
ঢাকা: গত চার বছরে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মধ্যে একটি বাস্তবায়নে ব্যাপক অগ্রগতি দেখা গেছে। আরও পাঁচটি লক্ষ্য বাস্তবায়নও অগ্রসরমান। এর ফলে দারিদ্র্য নিরসনে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। এছাড়া জাতীয় উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ও নিম্ন দারিদ্র্য রেখার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা স্থিতিশীলভাবে কমছে। ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশুর অনুপাতের পাশাপাশি পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুর হারও ধারাবাহিকভাবে কমছে। এর বাইরেও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ঊর্ধ্বগতি এসেছে এবং দেশের টেলিযোগাযোগ পদ্ধতির আধুনিকায়ন ঘটেছে।
অবশ্য এসডিজি’র ১৭ লক্ষ্যের মধ্যে বাকি ১১টি লক্ষ্যের বাস্তবায়ন সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। এর মধ্যে একটি লক্ষ্য বাস্তবায়নের পরিস্থিতি অবনতিশীল। তথ্য-উপাত্তের অভাবে চারটি লক্ষ্য মূল্যায়নই করা যায়নি। বাকি ছয়টি লক্ষ্য অর্জনের বাস্তব পরিস্থিতি অনেকটাই স্থবির হয়ে রয়েছে। তবে সরকার বলছে, এসএডিজি বাস্তবায়ন কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে বাস্তবায়ন কার্যক্রম। সঙ্গে এসডিজি’র ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণে কাজ করছে সরকার।
‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট: বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত চার বছরে দেশে এসডিজি বাস্তবায়নের নিরিখে এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।
মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দিয়ে প্রতিবেদনটির মোড়ক উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
১৭ এসডিজির বর্তমান চিত্র
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ‘দারিদ্র্য বিলোপে’র ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিমিত ও সঠিক পথেই রয়েছে। এছাড়া আরও পাঁচটি লক্ষ্যকে ‘পরিমিত মাত্রায় দুর্বল’ হলেও ‘অগ্রসরমান’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই পাঁচটি লক্ষ্য হলো— ক্ষুধামুক্তি; সুস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ; জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন; সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি; এবং অভিঘাত সহিষ্ণু অবকাঠামো, টেকসই শিল্পায়ন ও উদ্ভাবন।
প্রতিবেদনে ছয়টি লক্ষ্যের বর্তমান অবস্থাকে ‘দুর্বল ও স্থবির’ বলা হয়েছে সেগুলো হলো— স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং শোভন কর্মসংস্থান; টেকসই নগর ও জনবসতি; জলবায়ু কার্যক্রম; শান্তি, ন্যায় বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান; টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব; এবং জলজ জীবন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থলজ জীবনের লক্ষ্যটি খুবই দুর্বল ও অবনতিশীল অবস্থায় রয়েছে। আর তথ্য-উপাত্তের অভাবে যে চারটি লক্ষ্য মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি সেগুলো হলো— নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিস্কাশন; অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা; অসমতা হ্রাস; এবং পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদন।
ছয় খাতের অগ্রগতির খতিয়ান
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ যে কয়েকটি লক্ষ্য বাস্তবায়নে অগ্রসরমানতা দেখা যাচ্ছে, তাতে করেই ছয়টি খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী এই ছয়টি খাতের অর্জনগুলো তুলে ধরা হলো—
দারিদ্র্য দূরীকরণ
জাতীয় দারিদ্র্য রেখা ও নিম্ন দারিদ্র্য রেখার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার স্থিতিশীলভাবে কমছে। ২০১৯ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি নিম্ন দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত নেমে এসেছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে। সরকারের ঘাত সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বহুমাত্রিক নীতি ও কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার দারিদ্র্য মোকাবিলা করেছে।
খর্বকায়, কৃষ্ণকায় ও কম ওজনের শিশুর হার
গত চার বছরে দেশে খর্বকায়, কৃষ্ণকায় ও কম ওজনের শিশুর হার কমেছে। এছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী খর্বকায় শিশুর অনুপাত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ১৯৯৬-৯৭ সময়ে এই বয়সী শিশুদের মধ্য খর্বকায় হওয়ার হার ছিল ৬০ শতাংশ। ২০১৯ সালে সেটি কমে গিয়ে ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি ২০১৯ সালে কৃষ্ণকায় শিশুর হার নেমে এসেছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে, যা ২০১৪ সালেও ছিল ১৪ শতাংশ। এছাড়া কম ওজনের শিশুর অনুপাত ২০১৭ সালে ছিল ৪১ শতাংশ, ২০১৯ সালে সেটি নেমে এসেছে ২২ দশমিক ৬ শতাংশে।
শিশু মৃত্যু ও অগ্রিম গর্ভধারণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃতুর হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। এই সময়ে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা প্রতি হাজারে ১২৫ জন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ জনে। এক্ষেত্রে ২০২০ সালের নির্ধারিত মাইলফলক অর্জনে সঠিক পথেই রয়েছে দেশ। এছাড়া ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভধারণ হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ১৯৯৯ সালে প্রতি হাজার কিশোরী মায়ের সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন, ২০১৯ সালে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ৮৩ জনে।
শিক্ষা সমাপ্তি ও জেন্ডার গ্যাপ
২০১২-১৩ সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীর হার ছিল ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯ সালে সেটি বেড়ে হয়েছে ৮২ দশকি ৬ শতাংশ। এছাড়া ২০১৯ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপনীর হার যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ৭ ও ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচকে ১৫৩টি দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সূচকে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। গত পাঁচ বছর প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
মাথাপিছু গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রকৃত মাথাপিছু গড় বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতির ধারা উল্লেখ করার মতো। ২০১৪-১৫ সময়ে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সময়ে তা ৬ দশমিক ৯১ শতাংশে উন্নীত হয়। তব সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের কারণে প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে এর মধ্যেও প্রবৃদ্ধি ধারা বজায় রাখতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন
২০১৯ সালে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ কোটি ৭৫ লাখে উন্নীত হয়েছে। প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠীর কাছে টু-জি মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা পৌঁছেছে। এক্ষেত্রে ২০২০ সালের জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, সেটি ২০১৯ সালেই অর্জিত হয়েছে। এখন থ্রিজি ও ফোরজি সেবার আওতায় এসেছে ৭৯ শতাংশ মানুষ।
পাঁচ ‘পি’-তে সমন্বিত উদ্যোগ
এসডিজি বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগের প্রতিফলন দেখা গেছে বলে জানালেন প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত জিইডির সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, গত চার বছরে দেশে এসডিজি বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগের প্রতিফলন ঘটেছে। দাঁড়িয়েছে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো। এসব উদ্যোগের মধ্যে পাঁচটি ‘পি’ অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো— পিপল বা জনসমষ্টি, প্রসপারিটি বা সমৃদ্ধি, পিস বা শান্তি, পার্টনারশিপ বা অংশীদারিত্ব এবং প্ল্যানেট বা ধরিত্রী। এসডিজি বাস্তবায়নে এই বিষয়গুলোর প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে।
এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড় করাতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে ড. শামসুল আলম বলেন, সম্পদ সংগ্রহের ওপর গুরুত্ব আরোপ, প্রযুক্তি জোরদারকরণ, সক্ষমতা গড়ে তোলা, নির্বিঘ্নে বাণিজ্য করার মতো বিষয়গুলোতে সরকার জোর দিয়েছে। এছাড়া নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় সাধন, উপাত্ত ও বহু-অংশীজন অংশীদারিত্ব এবং পরিবীক্ষণ ও জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হয়েছে। দেশের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) ছাড়াও দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় এসডিজির অভীষ্ট ও লক্ষ্যের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নে অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছে।
এসডিজি এসডিজি বাস্তবায়ন টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্য ড. সামশুল আলম পরিকল্পনা কমিশন সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সাফল্য