সিনহা হত্যার পর পুলিশের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
২৯ আগস্ট ২০২০ ১৩:৩৭
ঢাকা: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর সারাদেশে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে ক্রসফায়ার, চাঁদাবাজি, ধরে নিয়ে গিয়ে টাকা আদায় এবং মাদক মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা কেউ আদালতে মামলা, আবার কেউ সরকারের বিভন্ন দফতরে অভিযোগ করেছেন।
সংশ্লিষ্ট থানা এবং ভিকটিমদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, গত ১০ আগস্ট ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগে রাজধানীর কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ছয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন হয়েছে কাপড় ব্যবসায়ী মো. সোহেল। আদালত মামলাটি সিআর হিসেবে গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
মামলার অভিযুক্তরা হলেন- কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান, উপপরিদর্শক (এসআই) পবিত্র সরকার, খালেদ শেখ ও মো. শাহিনুর, কনস্টেবল মিজান এবং সোর্স মোতালেব। অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঈদের পরদিন ২ আগস্ট বিকেলে ওই ব্যবসায়ীকে ধরার পর থানায় নিয়ে রাতে পরিবারকে ফোন করে সাড়ে তিন লাখ টাকা দুই দফায় আদায় করে পুলিশ।
এরপর ১৩ আগস্ট চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর কদমতলী থানা পুলিশের এসআই নাজমুলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন ইমরান হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে ডিবিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। বাকি আসামিরা হলেন- লাভোলা আইসক্রিমের এরিয়া ম্যানেজার উজ্জ্বল হোসেন, মার্কেটিং অফিসার্স সানাউল হক, তরিকুল, জুবায়ের, সজীব, আলম, শামীম ও রবিউল।
অভিযোগে বলা হয়, ইমরান হোসেনকে অপহরণ করে শ্যামপুর ইকোপার্কে নিয়ে আটকে রেখে মাদক ও অস্ত্র দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে তার দোকানের চাবি চায়। পরে আসামিরা তার মায়ের কাছ থেকে দোকানের চাবি নিয়ে ৭৫ হাজার টাকা মূল্যের আইসক্রিম, নগদ এক লাখ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের চেক বই এবং দু’টি ফ্রিজ নিয়ে নেয়। বাদীকে মেরে ফেলার হুমকি ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষরও নেয় আসামিরা।
এদিকে, গত ১৬ আগস্ট চাঁদা দিতে না পারায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে ওমান ফেরত এক প্রবাসীকে তুলে কক্সবাজারে নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’র অভিযোগে চকরিয়া থানার ওসিসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের নামে আদালতে একটি মামলা করেন নিহতের এক স্বজন। আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- চকরিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও চকরিয়া উপজেলার হারবাং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম। অজ্ঞাতনামা আরও ১০ থেকে ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, জাফর দীর্ঘদিন ধরে ওমানে ছিলেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর আগে তিনি দেশে ফেরেন, কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ায় আর ওমানে যেতে পারেননি। গত ২৯ জুলাই রাতে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক এসে জাফরকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর চকরিয়া থানার এসআই আমিনুল ফোন করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় ৩১ জুলাই তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়।
বাদীর আইনজীবী নুর মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে জাফরকে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত মামলা গ্রহণ করেছেন এবং সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।’
গত ১৯ আগস্ট দুই লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ক্রসফায়ারের হুমকি এবং পরবর্তী সময়ে ইয়াবা সংক্রান্ত মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে আট পুলিশ সদস্যসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা করেন আব্দুল ওয়াহেদ নামে এক ব্যবসায়ী। আদালত মামলা গ্রহণ করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উত্তর জোনের উপকমিশনারকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
অভিযুক্তরা হলেন- নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সহিদুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) মো. নুর নবী ও গোলাম মোহাম্মদ নাছিম হোসেন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) অমিত ভট্টাচার্য, মো. শরিফুল ইসলাম ও আশরাফুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. সোলাইমান ও ফৌজুল করিম এবং পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত রুবেল।
মামলার বাদী বায়েজিদ বোস্তামি থানার আরেফিন নগর এলাকার সুমাইয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অভিযোগে বলা হয়, গত ১৩ জুলাই রাতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা সোর্স রুবেলসহ তার বাসায় যায়। পুলিশের হটলাইন নম্বর-৯৯৯-এ কল পেয়ে ওই বাসায় অভিযান চালানোর কথা জানান তারা। তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়। টাকা দিতে না পারলে তার বাসা থেকে ইয়াবা উদ্ধারের মিথ্যা অভিযোগ এনে একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় আদালত তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতরসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। পুলিশ অধিদফতর সূত্র জানায়, সিনহা হত্যার পর আগের চেয়ে অনেক বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে ঠিক কি কি বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে তার জানা যায়নি।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) মো. সোহেল রানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। পরে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহসানের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা মামলার বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা না বললেও পুলিশের একজন ডিআইজি নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশে আগের চেয়ে অভিযোগের সংখ্যা কমেছে, এটা শাস্তির ফলে হয়েছে। পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এখানে যাদের শাস্তি হয় তা প্রকাশ হয় না। এর বাইরে ওসি মোয়াজ্জেমের বিচার চলছে। শত শত পুলিশ সদস্যের বিচার চলছে আদালতে। কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এখনও যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলোও তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কেন এত অভিযোগ আর এতে সাধারণ মানুষের আস্থার বিষয়ে কোনো সংকট তৈরি হবে কিনা জানতে চাইলে নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু কিছু ঘটনায় পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের একটি নেগেটিভিটি কাজ করছে। তবে এর মানে একেবারেই যে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার বলবো না। দিন শেষে পুলিশের কাছেই সকলকে যেতে হয়। ১৭/১৮ কোটি মানুষের দেশে অল্প সংখ্যক পুলিশের কাছে সবকিছু চেয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবার বিভ্রাট ঘটবেই। এরপরও পুলিশকে আরও বেশি জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশে শাস্তির বিষয়টি সাধারণ জনগণ দেখতে পায় না। আবার অনেকে পার পেয়ে যায়। সেই জায়গাগুলোও এড্রেস করা দরকার। যাতে কেউ অপরাধ করে পার পেতে না পারে। এটি একটি কল্যাণমুখী রাস্ট্র ও মানবিক পুলিশ গঠনের স্বার্থেই হওয়া উচিত। সবশেষে মানুষ চোখ রাখছে সিনহার বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। এটির ফলাফল সাধারণ মানুষের আস্থায় নিয়ে যাবে। সেটি হোক পজেটিভ আর হোক নেগেটিভ।’
উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাতে (ঈদের আগের রাত) অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে টেকনাফ থানার ওসির পরিকল্পনায় গুলি করে হত্যা করা হয় বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। এ ঘটনার পর টেকনাফ থানা পুলিশের সাত জনের নামে মোট তিনটি মামলা দায়ের হয়। এরমধ্যে সিনহার বোন আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন।