কাজী জাফরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন বন্ধু-সহকর্মীরা
২৯ আগস্ট ২০২০ ২০:৪০
ঢাকা: জাতীয় পার্টির (একাংশ) প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন তার বন্ধু-সহকর্মীরা। শনিবার (২৯ আগস্ট) ভার্চুয়াল আলোচনায় তারা এ স্মৃতিচারণ করেন।
কাজী জাফর আহমদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এ আলোনা সভায় অংশ নেন শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, শিক্ষাবিদ আতিকুর রহমান সালু ও ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
‘ইতিহাসে সম্মুজ্জ্বল কাজী জাফর আহমদ’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন প্রয়াত কাজী জাফরের মেয়ে কাজী জয়া আহমদ।
বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘সে আমার বিশেষ বন্ধু ছিল, ক্লাসফ্রেন্ড ছিল, আমরা একই ব্যাচের ছাত্র। আমি এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম, কাজী জাফরও ছিল। সে প্রায়ই আসত, রাজনৈতিক কারণেই আসত। তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতো, আলাপ হতো। হলকে উপলক্ষ করেই জানাশুনা শুরু। বন্ধুত্ব একটা বিশেষ বন্ধুত্বে পরিণত হয়।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি ছাত্র রাজনীতি করিনি, কাজেই সেই দিক থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কারণ ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে একটা পিআইয়ের ফ্লাইট ছিল ঢাকায় আসার। মাঝখানে কুমিল্লায় থামতো। একটা ফ্লাইটে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছি কুমিল্লায় থামলো। যারা কুমিল্লার যাত্রী তারা নেমেছে। কুমিল্লা থেকে ঢাকার যাত্রী উঠল।’
‘তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম দাঁড়ি-গোফওয়ালা একজন চাদর গায়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে ঢুকলো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না—কেন তাকালো? মুহূর্তে আমার আমার পাশে এসে মাথা নিচু করে বলল, আমি কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে আছি, আপনি কিছু বলবেন না। আমি এইমাত্র চিনলাম, আগে তো বুঝিনি।–এই হচ্ছে কাজী জাফর। তখন বুঝলাম যে, আন্ডারগ্রাউন্ডটা কি জিনিস’— বলেন ড. ইউনুস।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাফর ভাই অসাধারণ নেতা ছিলেন। তার একটা মেমোরি ছিল। একটা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষকে আপন করে নেওয়ার এবং নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবার। আমাদের কাছে নায়ক ছিলেন, হিরো ছিলেন। সত্যি উনি একেবারে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতেন।’
‘তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র, উনি সবসময় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো রাজনীতিতে বিচরণ করছেন। তিনি যখন ছাত্র রাজনীতি করেছেন সকলের কাছে আইডল ছিলেন, তিনি যখন শ্রমিক রাজনীতিতে গেলেন সেখানে কিংবদন্তি শ্রমিক নেতা ছিলেন’— বলেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘কাজী জাফর আহমেদ শেষ পর্যন্ত আন্দোলন করেছেন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। শেষ সময়ে তিনি বলেছেন, আমি যেতে চাই মানুষের ভালোবাসা নিয়ে। উনার একটাই লক্ষ্য ছিল- সমাজকে বদলে দেবেন, রাষ্ট্রকে বদলে দিয়ে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন। এখন তাকে আমার প্রায় মনে পড়ে। আজকাল তাকে খুব মিস করি। তার অনুপস্থিতিটা আমি অনুভব করি। আজকে যখন আমরা এরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছি, সেই অবস্থায় কাজী জাফরের প্রয়োজন ছিল।’
কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমরা জাতীয় পার্টিসহ তাকে আমাদের জোটে আনার জন্য কাজ করছিলাম। সেই সময়ে কয়েক দফা আমাদের সভা হয়েছে। প্রথম যে সভাটা উনি আমাদের ম্যাডামের সঙ্গে করতে গেলেন সেটা খুব স্মরণীয়। তখন সরাসরি ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করাটা তার জন্য বিপদজনক ছিল। কারণ দলীয় প্রধান ও অন্যান্যরা জানতে পারলে তার ক্ষতি হতে পারে। এজন্য তিনি বললেন যে, আমি ছদ্মবেশে যাব।’
‘এখনও আমার মনে আছে, তিনি আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। আমি যখন প্রথম দেখলাম, তখন তাকে চিনতে পারিনি। আসকান পরা, মাথা টুপি, মুখে দাঁড়ি। আমাকে বললেন যে, কি চিনতে পারছো। আমি বেশ কিছু সময় লাগছে চিনতে। এরপর গাড়ি বদল করে ম্যাডামের বাসায় গিয়েছিলাম। জাফর ভাইকে সেদিন ম্যাডাম চিনতেও পারেননি। ম্যাডাম বললেন, কাকে নিয়ে এলেন? উনাকে কিন্তু চিনতে পারছি না’— বলেন মির্জা ফখরুল।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘জাফর ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা দীর্ঘকালের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে শ্রমিক আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন সবক্ষেত্রে আমরা প্রায় একসঙ্গেই পথ চলেছি। বলতে পারেন জাফর ভাই আমাদের নেতা ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা এতই অবিচ্ছেদ্য ছিল যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন আমরা ভারতে আশ্রয় নিয়ে এই লড়াইয়ে ক্ষেত্রে সংগঠিত করার চেষ্টা করছি, সে সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে আমার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ আমাকে দেখে বললেন যে, জাফর-মেনন আপনারা এসেছেন। আমি বললাম জি না, আমি মেনন, কাজী জাফর আরেকজন। উনি বলছেন যে, ওহ জাফর-মেনন একটি নাম।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে পথ চলেছি। ছাত্র আন্দোলন বিশেষ করে শিক্ষা আন্দোলনে জাফর ভাইয়ের যে অতুলনীয় নেতৃত্ব সেই নেতৃত্ব সবাই স্মরণ রাখবে। এই শিক্ষা আন্দোলনে প্রতিটি ঘটনায় তার বক্তৃতা মানুষকে এতই মোহগ্রস্ত করত, এমন উদ্বেলিত করত যে, এ রকম আর দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমার একটি কথাই মনে আছে- ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলনে যখন গুলি হলো তখন ওয়াজি উল্লাহ, মামুন মুস্তফা মারা গেলেন। এরপর মেডিকেলের ভেতরে লাশের সামনে দাঁড়িয়ে যে তিনি যে বক্তৃতা করেছিলেন, সেই বক্তৃতা শুনে ওখানে দাঁড়ানো সমস্ত মানুষ কেঁদেছিল। এতদূর তার বক্তৃতার প্রভাব ছিল।’
মেনন বলেন, ‘ভিন্ন পথযাত্রায় আমরা স্বাধীনতার সূর্য দেখেছিলাম। সেই পথযাত্রায় আমাদের নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমদ, যাকে আমরা চিরকাল স্মরণ করি। তার জীবনের সঙ্গে যেমন ঘনিষ্ঠ ছিলাম, তার আকস্মিক মৃত্যুর দিনেও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাকে শেষ বিদায় জানাবার।’
তিনি বলেন, ‘কাজী জাফর এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন অন্যতম সংগঠক হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবং এদেশের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের সংগঠনের নেতা হিসেবে আমাদের মাঝে অম্লান থাকবেন এবং আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল সম্মুজ্জ্বল থাকবেন।’
কাজী জাফর আহমেদ জাতীয় পার্টি ড. মুহাম্মদ ইউনুস ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মোস্তফা জামাল হায়দার রাশেদ খান মেনন