Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নেই তাজিয়ার জৌলুশ, আশুরা পালনে ভিন্নভাবে প্রস্তুত হোসেনি দালান


২৯ আগস্ট ২০২০ ২০:৫৭

ঢাকা: সিল্কের নিশান, লাঠির ঠোকাঠুকি, তলোয়ারের ঝলসানি, আগুনের চরকি এবং সেইসঙ্গে টানা দশদিনের জন্য হরেক রকমের খাবার ও জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে মেলা। প্রতিবছর পবিত্র আশুরার তাজিলা মিছিল উপলক্ষে এরকম ঐহিত্য আয়োজন নিয়ে সাজে পুরানো ঢাকার হোসেনি দালান। মূলত এসব শিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান আশুরার চারশ’ বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু ২০১৫ সালে হোসেনি দালান ইমামবাড়ায় বোমা হামলার পর নিরাপত্তা জোরদারে তাজিয়া মিছিলে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এতে নিষিদ্ধ করা হয় লাঠির ঠোকাঠুকি, তলোয়ারের ঝলসানি আর আগুনের চরকি।

বিজ্ঞাপন

গত চার বছর পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বুক চাপড় দিয়ে সিলকের নিশান উড়িয়ে মিছিল করা আর মেলা বসানোয় ছিল অবশিষ্ট ঐতিহ্য। তবে করোনার প্রভাবে এবার তাতেও রয়েছে নানা-বিধি নিষেধ। এবার করোনার সংক্রমণ রোধে বন্ধ করা হয়েছে তাজিয়া মিছিল। নেই মানুষের সমাগমের সেই ঐতিহ্যবাহী হোসেনি দালান এলাকার মেলা। এমন নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে পবিত্র আশুরা জৌলুশ হারাচ্ছে বলে মনে করছেন আয়োজক ও আগত দর্শনার্থীরা।

বিজ্ঞাপন

শনিবার (২৯ আগস্ট) সকালে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল সংলগ্ন চাঁনখারপুর এলাকায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী হোসেনি দালান ইমামবাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, গতবারের মতো এবার নেই জাকজমকপূর্ণ আয়োজন। প্রতি বছর আশুরা উপলক্ষে দশদিন আগ থেকে শুরু হয় চাঁনখারপুল মোড় থেকে বকশিবাজার মোড় পর্যন্ত মেলা। কিন্তু এবার দালানের বাহির থেকে দেখে বোঝার সুযোগও নেই যে মাত্র একদিন পর আশুরা। কারণ বাহিরে নেই দর্শনার্থীদের ভিড়। এছাড়া নিয়মিত দোকানগুলোর অধিকাংশই করোনার কারণে বন্ধ রয়েছে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার এ বছর তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে জনসমাগমে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। তাই আয়োজকরাও বিধি-নিষেধ মেনে যতটুকু সম্ভব ততটুকু আয়োজনের চেষ্টা করছে।

করোনার জীবণুনাশক টানেল পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ছুটে আসছেন। কিন্তু সংখ্যায় তা অন্যবারের তুলনায় একেবারেই কম। তবুও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দালানের ভেতরে অবস্থান নেওয়াদের কেউ কেউ জড়ো হয়ে কারবালার সেই দিনের শোকের মাতল তুলে ‘হায় হোসেন-হায় হাসান’ বলে বুক চাপড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ভেতরে অবস্থিত মিনার অবয়বে প্রার্থনা করছেন। আর কেউ কেউ শিয়া সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের কবর জিয়ারত করছেন। তবে গত কয়েকবছরের মতো এবারও দেখা যায়নি রক্তাক্ত স্মৃতির স্মরণে জিঞ্জির (একাধিক ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে তৈরি) দিয়ে শরীরকে আঘাত করার দৃশ্য।

হোসেনি দালানের ভেতরে কথা হয় নুর আহমদ মোস্তফা নামের একজনের সঙ্গে। ত্রিশোর্ধ্ব বয়সের মোস্তফা সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আশুরা উপলক্ষে বাবার সঙ্গে এখানে আসি। আগে আমার বাবা জিঞ্জির দিয়ে শরীরের আঘাত করে রক্তাক্ত করতো। বাবার মত অনেকেই করতো। মূলত আমাদের কাছে সেই আঘাত, সেই রক্তাক্ত দৃশ্যই সবচেয়ে বেশি স্মরণ করাতো সেই নির্মম কারবালার ঘটনার কথা। ওই দৃশ্যই আমাদের সত্যিকার অর্থে কারবালার প্রান্তর সম্পর্কে জানতে আগ্রহ বাড়াতো। এ কারণেই বছরের পর বছর ধরে এ ঐতিহ্য বিদ্যমান। কিন্তু এখন তো তা বন্ধ রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আগামী প্রজন্ম কতটুকুই বা জানতে পারবে। তবুও মিছিলে মিছিলে তাজিয়ার (শোক) মাধ্যমে সমস্বরে ওঠা ধ্বনি যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লা তখনও নতুন প্রজন্ম অন্তত এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারতো। কিন্তু এবার করোনার কারণে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। তাই এবার আমরা দালানের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই মাতম করছি।’

লালবাগ থেকে পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে এসেছেন সাইফুল মোল্লা নামের এক যুবক। তিনি সুন্নী সম্প্রদায় হলেও গত কয়েক বছর ধরে আশুরা উপলক্ষে এখানে আসেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনুষ্ঠানটি শিয়া সম্প্রদায়ের হলেও সুন্নীদের প্রবেশে বাধা নিষেধ নাই। তাই গত তিন চার বছর ধরে আশুরার আগের দিন এখানে আসি।’

প্রতিবছরে আসার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মূলত দুটি কারণে এখানে আসা হয়। প্রথমত কারবালার প্রান্তরে হযরত মুহম্মদ (সা.) এর নাতি শহীদ হওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করে আসি। আর দ্বিতীয়ত সন্তান হওয়ার পর তাকে ও স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আসি মেলা থেকে নানা রকমের খাবার-দাবার এবং জিনিসপত্র কিনতে। কারণ এখানকার মেলা কিন্তু অন্যান্য সাধারণ মেলার মতো নয়। এখানকার মেলায় একটা শিষ্টাচার থাকে। কিন্তু এবার যখন জানলাম মেলা হবে, তখন ছেলের মন কিছুটা খারাপ।

এ বিষয়ে আয়োজক কমিটির সভাপতি কাজী মো. দেলোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু করোনার কারণে সরকার তাজিয়া মিছিলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাই আমরাও এবার মিছিল বাইরে বের করব না। তাজিয়া মিছিলসহ সব আয়োজন এবার আমরা হোসেনি দালানের ভেতরেই করছি।’

তিনি বলেন, ‘তবে কিছুটা খারাপ লাগছে এটা ভেবে যে, নানান বিধি-নিষেধে যেভাবে এ তাজিয়ার দিনটিতে আমাদের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকগুলোকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বন্ধ করা হচ্ছে তাতে খুব শঙ্কা হয়; যদি ভবিষ্যতে এ ঐতিহ্য বাধাগ্রস্ত হয়। যদিও এবার করোনার কারণে বন্ধ হচ্ছে। তাই আমাদেরও তেমন কিছু বলার নেই। তবুও অন্যবারের তুলনায় এবার একটু অন্যরকমই মনে হচ্ছে। তবে আগামী প্রজন্মকে অবশ্যই এ দিনটির কথা মনে করিয়ে দিতে চাই আমরা। এজন্য আমাদের সব প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার স্বাস্থ্যবিধি হিসেবে যেসব আয়োজন করা দরকার আমরা সবকিছুর ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা প্রধান গেটে জীবাণুনাশক টানেল বসিয়েছি। সেখান দিয়ে প্রবেশের সময় শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারেরও ব্যবস্থা রেখেছি। সেই সঙ্গে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করেছি।’

আশুরা উপলক্ষে নিরাপত্তা জোরদার

এদিকে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে গত পাঁচদিন ধরে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) হোসেনি দালান এলাকায় কড়া নিরাপত্তা জোরদার করেছে। সাদা পোশাকেও দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা। সেইসঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে সিসিটিভি। এলাকায় ডগ স্কোয়াড ও বোম ডিসপোজাল ইউনিটের টহল অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও স্থাপন করা হয়েছে জরুরি কন্ট্রোল রুম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মুখপাত্র মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, ‘যেকোনো ধরণের তাজিয়া ও পাইক মিছিল এবার বের করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমামবাড়ার ভেতরে ধর্মীয় আচার-আনুষ্ঠান করতে তাদের যেসব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন সেসবের সবকিছু করা হয়েছে।’

আগুনের চরকি আশুরা তলোয়ারের ঝলসানি তাজিয়া মিছিল লাঠির ঠোকাঠুকি শিয়া সম্প্রদায় সিল্কের নিশান হোসেনি দালান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর