‘প্রযত্নে ক্যানভাসে’র উদ্যোগে হাসপাতালের অক্সিজেন সরবরাহে বদল
৩০ আগস্ট ২০২০ ০০:১৮
ইতিহাস আমাদের জানায় যে, প্রতিটি মহামারি এবং তার পরবর্তী সময়টাতে মানুষ দলবদ্ধ হয়েছে। চলমান কোভিড-১৯ মহামারিতেও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি আর সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। বাংলাদেশে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নানা ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগ আর সমবায় কার্যক্রম নিয়ে অজস্র মানুষ অবদান রাখছেন দুর্গতদের সহায়তা করতে। কোথাও চলছে ত্রাণ প্রদান, কোথাও অনলাইনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, কোথাও চলছে স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান।
পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের মতো বিপর্যস্ত এই সময়ে আক্রান্ত মানুষে জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও। তাদের উদ্যোগ ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ কাজ করছে প্রকৌশল বিদ্যার জ্ঞান কাজ লাগিয়ে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে একটি দীর্ঘমেয়াদি সেবা যুক্ত করতে।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতি জরুরি একটি সেবা হলো অক্সিজেন প্রদান। কিন্তু বর্তমানে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে- সেটা সাধারণ হোক, বা করোনার জন্য নির্ধারিত- অক্সিজেন সরবরাহের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা (Central Distribution System) নেই। আইসিইউ (intensive care unit) কিংবা ভেন্টিলেটরেও (ventilator) প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, যা দেশে বিদ্যমান অক্সিজেন সিলিন্ডারের বর্তমান মজুদ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ আয়োজনের উদ্যোক্তারা বড় আকারের High Pressure Gas Cylinder অথবা Cylinder Manifold System ব্যবহার করে হাসপাতালগুলোয় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা প্রস্তুত করছেন সীমিত পরিসরে। ফলে সম্ভব হচ্ছে, রোগীদের শয্যায় কিংবা আইসিইউ’তে সহজেই অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ফেসবুক মেসেঞ্জারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একটি নিজস্ব গ্রুপ থেকেই সব কিছুর সূচনা। কোভিড মহামারিজনিত সংকটে প্রকৌশলীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনার পর অবশেষে আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়।
উদ্যোগের সার্বিক সমন্বয়ক মিঠুন রাহা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, যে জ্ঞানের সুষ্ঠু প্রয়োগ ছাড়া সমাজের কোনো ক্ষেত্রেই স্থায়ী ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব না। কাজেই যখন মহামারির সংকট দেখা দিলো, আমরা তখন চেয়েছি নিজেদের প্রকৌশল বিদ্যার কারিগরি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে এমন কিছু করতে, যাতে দীর্ঘমেয়াদে মানুষের উপকার হয়।’
পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর দ্রুতই শুরু হয় সেটা বাস্তবায়নের কাজ। প্রথমেই যোগাযোগ করা হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষদের সাথে। সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগ্রহ প্রকাশ করায় তাদেরই বেছে নেওয়া হয় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা তখন দ্রুত হাসপাতালটি পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাটির নকশা প্রণয়ণ করেন, এবং একই সাথে শুরু হয় অর্থ সংগ্রহের কাজটাও। Technical Wing, Fund Collection Wing, Media Wing- এই তিন দলের সাথে অগণিত শুভার্থী ও দাতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনার এক মাসের মাঝেই চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের ৪২টি শয্যায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়।
উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত অর্থের সংস্থান আসে ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই।
পাইলট প্রকল্পের এই সাফল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ এর উদ্যোক্তাদের মনোবল। ফলে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের কাজের আওতা, এবং জনসেবার এই উদ্যোগে সামিল হয় কিছু প্রতিষ্ঠানও। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী, মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ইস্পাহানি গ্রুপসহ আরও অগণিত মানুষের কাছে অকুণ্ঠভাবে ঋণ স্বীকার করে ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ বিগত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সম্পন্ন করেছে অনেকগুলো হাসপাতালে সীমিত পরিসরে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যুক্ত করার কাজ।
যেসব হাসপাতালে এখন পর্যন্ত সীমিত পরিসরে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো- চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল, হাটহাজারি উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চকরিয়া উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স, বি.আই.টি.আই.ডি. হাসপাতাল, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা ডায়বেটিক হাসপাতাল, চাইল্ড হেলথ অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি হাসপাতাল।
এছাড়াও, নোয়াখালি জেনারেল হাসপাতাল এবং ময়মনসিংহের এস. কে. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথেও আলোচনা চলছে ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ এর।
‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ এর এই কাজের পর আমূল পালটে গেছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর জনসেবার চিত্র। আগের চেয়ে আরো নিপুণভাবে, আরো দ্রুত তারা সেবা দিতে পারছেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিকাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (বি.আই.টি.আই.ডি.) হাসপাতালের পরিচালক ডা. এম এ হাসান বলেন, ‘করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সরবরাহের বিকল্প কোনো ওষুধ নাই। আগে আমরা ছোট সিলিন্ডারে করে অক্সিজেন ব্যবহার করতাম, সেটা দ্রুতই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এখন যেহেতু কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা গেছে, কাজেই আগের চাইতে অনেক বেশি রোগীকে আমরা স্বল্প সময়ে সেবা দিতে পারবো।’
‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ এর পক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের পুরো ব্যবস্থাটির সংশ্লিষ্ট কারিগরি সমস্যাগুলোর সমাধান করেছেন মো. আবু নাসের, শাহনেওয়াজ রহমান এবং জিয়াউদ্দীন আহমেদ। এই তিন প্রকৌশলী বলেন, ‘আমরা চেয়েছি খরচ যথাসম্ভব অল্প হবে, অথচ কাজের গুণগত মানের সাথে কোনো আপস হবে না। আর রোগীদের সুরক্ষার ব্যাপারেও আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। প্রতিটি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে, যাতে করে সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়।’
সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা এখন চান এই কার্যক্রমকে দেশের আরো অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে। তবে বলাবাহুল্য, দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের উদ্যোগকে আরো বৃহত্তর পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন বড় আকারের পৃষ্ঠপোষকতা। এক্ষেত্রে সরকার বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সেটি নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাই প্রয়োজন সহৃদয় নাগরিকদের অংশগ্রহণ।
স্থানীয়দের চাহিদা অনুসারে, দেশের অন্যান্য হাসপাতালের সাথেও কাজ করতে ইচ্ছুক ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’। এই উদ্যোগের আপডেট পাওয়া যাবে https://www.facebook.com/projotnecanvas06 ফেসবুক পেজে।
পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে অনুসন্ধান বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে আগ্রহীরা Mithun Raha (ME ’06, BUET), ম্যানেজার, ফিনিশিং, কোটস বাংলাদেশ লিমিটেড বা 01770570221 ফোন নম্বর অথবা [email protected] মেইলে যোগাযোগ করতে পারবেন।