‘কৌশলগত পরিবর্তন না আনলে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে’
৩০ আগস্ট ২০২০ ০৩:০৭
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এরকম পরিবর্তন আনার মতো পদক্ষেপ না নিতে পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
শনিবার (২৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘কোভিড স্টিগমা অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন হেলথ সার্ভিস ডেলিভারি’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে তারা এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
ওয়েবিনারে অংশ নেন ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের মেডিক্যাল অ্যানথ্রপোলজি অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ বিভাগের রিডার ডা. শাহাদুজ্জামান; জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক হেলথ, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ডা. তৌফিক জোয়ার্দার; এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের নিয়মিত এই আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
ওয়েবিনারে অংশ হিয়ে ডা. শাহাদুজ্জামান বলেন, সাধারণ চিকিৎসা আর মহামারি মোকাবিলা এক নয়। মহামারি সম্পূর্ণরূপে একটি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ইস্যু। তাই এটাকে চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়ে যতটা না, তার চেয়ে বেশি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি দিয়ে তার চেয়ে বেশি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। শুরু থেকেই এ ক্ষেত্রে আমাদের ফ্রেমিংটা ছিল ভুল। করোনাকে আমরা জনস্বাস্থ্য ইস্যু হিসেবে দেখতে পারিনি। জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় একটি অংশ কমিউনিকেশন, সেটিতেও ঘাটতি ছিল। মহামারিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সামাজিক যৌথ উদ্যোগ, সেখানে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হয়। সেখানেও ঘাটতি ছিল।
করোনাভাইরাস সম্পূর্ণ নতুন হওয়ায় ‘ফিয়ার অব আননোন’ কাজ করেছে জানিয়ে এই গবেষক বলেন, শুরুতে কিছু অপপ্রচারের কারণে আমরা বেপরোয়া চলাফেরা করেছি। করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রবাসীদের নিগ্রহ শুরু হলো। অনেকের বাড়িতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হলো— এটা প্রবাসীর বাড়ি। এটা ফরমাল স্টিগমাটাইজেশন। একটা পর্যায়ে তো বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার দেখা গেল— প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবাসীদের পেটানোর ঘটনাও ঘটেছে।
করোনাভাইরাস বহুমুখী ভীতি ছড়িয়েছে উল্লেখ করে ডা. শাহাদুজ্জামান বলেন, প্রথম যখন একজন মারা গেলেন, তিনি প্রবাসী ছিলেন না। তখন প্রকৃত অর্থে এক ধরনের ভীতি তৈরি হলো। এরপর লকডাউনে আরেক ধরনের ভীতি তৈরি হলো। পোশাক শ্রমিকদের ছুটি দেওয়ার পরে আবার ফিরিয়ে আনা হলো। তখন ফিয়ার অব লাইফের সঙ্গে ফিয়ার অব লাইভলিহুড যোগ হলো। চিকিৎসকদের পিপিই ছিল না, তারা রোগী দেখতে ভয় পাচ্ছিলেন। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম, বড় একটি অংশের মানুষের কোনো ভয় নেই। তখন লকডাউনের মাঝামাঝি পর্যায়। এই ভয়হীনতা আরও কিছু মানুষের ভীতির কারণ হয়েছে। ফিয়ার প্যানিক পর্যায়ে গেল, রোগী তখন হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, করোনা রোগীর বাড়িতে হামলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রথম প্রয়োজন সংক্রমণ বন্ধ করা। তার জন্য ঘরে থাকতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। ঘরে থেকে আর হাত ধুয়ে মানবজাতির এত উপকার করা যায়, সেটা জানার সুযোগ সভ্যতার এত বছরে আসেনি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় প্রসঙ্গে ডা. শাহাদুজ্জামান বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ বাস্তব পরিস্থিতি জানতে চায়। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি জানানো। এখনো স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করা দরকার। করোনা মোকাবিলাকে জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে পরিণত করতে হবে। তা না করতে পারলে সেকেন্ড ওয়েভ এলে সেটা সামলানোর কোনো পথ খোলা থাকবে না বলে মন্তব্য করেন ডা. শাহাদুজ্জামান।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গুর সময় আমরা দেখেছি, যারা সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ছিল না। একই পরিস্থতি আমরা আবার দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে রাজনীতিকরা উপেক্ষা করছেন, যে কারণে সাধারণ মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি ঈদুল আজহায় বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো জনগণের কাছে নেতিবাচক বার্তা দেয়।
আস্থাহীনতা তৈরিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায়ও আছে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসক। তিনি বলেন, কেউ কেউ ওষুধ পেয়ে গেছি দাবি করেছেন। সেটা কিন্তু পরবর্তী সময়ে জনগণকে আস্থাহীনতায় ফেলেছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল প্রান্তিক মানুষ নয়, শিক্ষিত মানুষের ভেতরেও হেলথ লিটারেসি, বিশেষ করে করোনা নিয়ে লিটারেসির অভাব আছে।
ডা. তৌফিক জোয়ার্দার বলেন, মহামারি ছাড়াও বাংলাদেশের হাসপাতালে রোগী নেই— এটা ভাবা যায় না। কেউ যদি দাবি করেন হাসপাতালগুলোতে রোগী নেই, এর অর্থ হলো মানুষ হাসপাতালে যেতে সাহস পাচ্ছে না। অথবা হতে পারে তারা মনে করছে না যে হাসপাতালে গিয়ে তারা সঠিক চিকিৎসা পাবে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি।
তিনি আরও বলেন, আমরা একটি গবেষণা করেছি। তাতে দেখা গেছে, সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা, চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর জনগণের আস্থা কম। আবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরিই আস্থা কম। হঠাৎ আমরা দেখলাম, কিছু কিছু পদে পরিবর্তন আনা হলো। এটা কি খুব কাজের কিছু? যতক্ষণ পর্যন্ত সিস্টেমে পরিবর্তন না আনা হচ্ছে, ব্যক্তির পরিবর্তন বড় ভূমিকা রাখবে না।
আস্থাহীনতা করোনা মোকাবিলা করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ কৌশলগত পরিবর্তন জনস্বাস্থ্য