Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় আটকে ঋণের বোঝা, হাত পাততে হচ্ছে ‘রেমিটেন্স যোদ্ধাদের’


৩০ আগস্ট ২০২০ ১১:১৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশে এসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে আটকে পড়া প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেরই দিন কাটছে এখন চরম দুর্দশায়। রেমিটেন্স যোদ্ধা আখ্যা পাওয়া এসব প্রবাসীর পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রায় সচল দেশের অর্থনীতি। অথচ এই রেমিটেন্স যোদ্ধাদেরই এখন হাত পাততে হচ্ছে সরকারের কাছে। কেউ কেউ ত্রাণের আশায় ধর্ণা দিচ্ছেন সরকারি অফিসে, কেউ-বা বিদেশ যাবার আশা ছেড়ে দিয়ে সরকারি ঋণের আশায় দিন পার করছেন।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে সরকারি কার্যভবন-১ এর নিচতলায় জেলা জনশক্তি, কর্মস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ডেস্কে গেলে প্রতিদিন দেখা মেলে অসহায় প্রবাসীদের। এদের মধ্যে কেউ কেউ কোভিড পরিস্থিতি শুরুর পর দেশে ফিরে আর যেতে পারেননি। কেউ বা আবার বছর শেষে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে এসে আটকে পড়েছেন। তাদের চোখেমুখে এখন হতাশার ছায়া।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মারাত্মক প্রভাবের কারণে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রমণ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। একের পর এক বিমান সংস্থাগুলো তাদের ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দেয়। বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মূলত দেশে আসা প্রবাসীদের অনেকের ভিসা থাকার পরও আর ফিরতে পারেননি। বহির্বিশ্বের শ্রমবাজার নিয়ে বিপর্যয়কর এই পরিস্থিতি এখনও সামলে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। স্বাভাবিক হয়নি যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে শর্ত মেনে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার তাদের শ্রমবাজার খোলার ঘোষণা দিয়েছে। সাত সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে ফ্লাইট।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘কোভিড পরিস্থিতিতে যারা দেশে এসে আটকে পড়েছেন তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক আবার ফিরেও গেছেন। বিশেষত চট্টগ্রাম থেকে সীমিত আকারে প্রবাসীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরছেন। কিন্তু বেশিরভাগ প্রবাসীই আটকে আছেন। অনেকেই আছেন যাদের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেছে, তারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। অনেকে আবার বিদেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগটি হারিয়েছেন অথবা যেতে আগ্রহী নন। সামগ্রিক একটা সংকট আছে। আশা করছি খুব দ্রুতই এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

সম্প্রতি আগ্রাবাদে জেলা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ডেস্কে গিয়ে কথা হয় চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গুজরা গ্রামের জসিম ওসমানের সঙ্গে। তিনি গত ডিসেম্বরে দুবাই থেকে আসেন। ফেরার কথা ছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। কিন্তু ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর ফিরতে পারেননি। জসিম ওসমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাখ তিনেক টাকা নিয়ে এসেছিলাম। ঘর মেরামত করেছি। ভেবেছিলাম এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চলে যেতে পারব। কিন্তু এর মধ্যেই সমস্যা শুরু হয়ে যায়। টাকা শেষ। আরও প্রায় লাখখানেক টাকা ধার নিয়েছি। এখানে এসেছিলাম, যদি কিছু অনুদান পাওয়া যায় উপকার হত।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া গ্রামের কাঞ্চন দাশ আবুধাবিতে একটি রেস্টুরেন্টে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। গত বছরের ৭ নভেম্বর তিনি দেশে আসেন। ১৯ মার্চ তার আবুধাবিতে ফেরার কথা থাকলেও ফ্লাইট বন্ধ থাকায় আটকে গেছেন। কাঞ্চন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রায় ১০ মাস ধরে বেকার বসে আছি। টাকা যেগুলো এনেছিলাম, সেগুলো দিয়ে একটি সেমিপাকা ঘর করেছি। আরও সাত লাখ টাকার মতো ধার হয়ে গেছে। বিদেশে ফিরতে পারলে ধার শোধ করতে পারতাম। এখন তো সেটাও পারছি না। আবুধাবির ফ্লাইট চালু হলেও আবার বন্ধ হয়ে গেছে। বারবার ট্রাভেল এজেন্সিতে যাচ্ছি, উনারা কোনো আশ্বাস দিতে পারছেন না।’

চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সি বি ফ্রেশ লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপক সুমন আইচ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লাইট অপারেশন বন্ধ। অনেকের টিকিটের মেয়াদ চলে গেছে। তারা আসছেন রি-শিডিউল করার জন্য। কিন্তু ফ্লাইট চালু না হলে তো আমরা টিকিট দিতে পারছি না। এর ওপর করোনা সনদ লাগছে। একটা অ্যাপ্রুভাল লেটার আবার অনলাইনে পাঠাতে হচ্ছে দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। সেটা ছাড়া অনেকে গিয়েও আবার ফেরত এসেছে। প্রতিদিনই প্রবাসীরা অফিসে আসছেন, কিন্তু আমরা তো উনাদের কোনো আশ্বাস দিতে পারছি না।’

জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গত ২৩ জুলাই থেকে চট্টগ্রামে প্রবাসীদের করোনা পরীক্ষা ও সনদ দেওয়া শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট ৬ হাজার ১৪১ জনের করোনা পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ২১৯ জনের করোনা পজেটিভ এসেছে। বাকিদের করোনামুক্ত হিসেবে সনদ দেওয়া হয়েছে।

করোনামুক্ত হিসেবে সনদ পাওয়াদের মধ্যেও অধিকাংশই ফ্লাইট চালু না হওয়া এবং টিকিট জটিলতার কারণে দেশ ছাড়তে পারেননি বলে প্রশাসনের কাছে তথ্য আছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। এই প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। এককভাবে শুধু সৌদি আরবেই আছেন অন্তত ২০ লাখের বেশি বাংলাদেশি। আরব আমিরাতে (ইউএই) আছেন ১৫ লাখ। ওমান-মালয়েশিয়ায় আছেন ১০ লাখেরও বেশি। এরপর কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, বাহরাইনে বেশি শ্রমিক কাজ করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, যুক্তরাজ্যে, কানাডাতেও বেশ ভালো সংখ্যক প্রবাসী আছেন।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক জরিপের বরাতে গণমাধ্যমে তথ্য প্রকাশ হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে বিদেশফেরত ৭০ শতাংশ প্রবাসীই উপার্জনহীন হয়ে চরম সংকটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ ঋণভারে আক্রান্ত। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের পাশাপাশি এনজিও, ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার কাছ থেকে সুদে ঋণ নিয়েছেন এমন প্রবাসীও আছেন। তবে বিদেশফেরত ৭৫ শতাংশই আবার ফিরে যেতে আগ্রহী।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৫০ লাখ (১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে, টাকার অংকে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন রেমিটেন্স এসেছিল।

চলতি মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, গত ১ এপ্রিল থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচমাসে ২৬টি দেশ থেকে ৮৫ হাজার ৭৯০ প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেছেন, যার মধ্যে ৫ হাজার ৬৫৭ জন নারী কর্মী আছেন। বিদেশফেরতদের মধ্যে মোট ২৭ হাজার ৬৫৮ জন ফিরেছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আর ১৭ হাজার ৩১৭ জন ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। এদের অধিকাংশই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বেকার হয়ে দেশে ফিরেছেন। এর বাইরে গত ২১ জানুয়ারি থেকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ছুটিতে আসা ৬ লাখ ২৪ হাজার শ্রমিকের বড় অংশ আটকে গেছেন।

চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রবাসীদের মধ্যে ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে দেশে আসার প্রবণতা বেশি। তখন সন্তানদের পড়ালেখার চাপ থাকে না। আবহাওয়া ভালো থাকে। সেজন্য তারা এইসময়ে দেশে ফেরেন। এবারও একই সময়ে দেশে ফিরে আটকে পড়েছেন চট্টগ্রামের প্রায় এক লাখ প্রবাসী। কোভিড পরিস্থিতি শুরুর পর চট্টগ্রামে কত প্রবাসী ফিরেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যন নেই। তবে কোভিড শুরুর আগে-পরে দেশে ফেরা প্রায় সবাই এখনও আটকে আছেন।’

জহিরুল জানান, দেশে আটকে থাকার পর অর্থকষ্টে পড়া প্রবাসীদের মধ্যে প্রতিদিন ৭০-৮০ জন করে তাদের কাছে আসছেন মানবিক সহায়তার আবেদন নিয়ে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাদের কাছে আবেদন জমা পড়েছে ৪২৬টি, যারা খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক অনুদানও চেয়েছেন। আর ঋণ সহায়তার আবেদন জমা পড়েছে ৯টি।

বিদেশফেরত কর্মীদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে সরকার ৫০০ কোটি টাকার একটি তহবিল অনুমোদন করেছে। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে বিনিয়োগ ঋণ প্রদানের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিলও গঠন করেছে।

জহিরুল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানবিক সহায়তার যেসব আবেদন পেয়েছি, সেগুলো আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। আর ঋণের বিষয়ে প্রবাসীদের মধ্যে একটু ভুল বোঝাবুঝি আছে। তারা মনে করছেন, সরকার তহবিল দিয়েছে, তারা বোধহয় আবেদন করলেই ঋণ পেয়ে যাবেন। বিষয়টি সেরকম নয়। প্রবাসীদের মধ্যে যারা চলতি বছরের ১ মার্চের পর দেশে এসেছেন এবং আর বিদেশে ফেরত যাবেন না তারাই শুধু ঋণ পাওয়ার যোগ্য। সেক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হবে মৎস্য চাষ, কৃষি, পোল্ট্রি ফার্ম, দুগ্ধ খামার, কুটির শিল্প, মুদি দোকান, মনোহারি দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ কয়েকটি ক্যাটাগরির উদ্যোক্তাদের জন্য। জামানতবিহীন চার শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হবে। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ২ শতাংশ হারে দণ্ডসুদ আরোপ হবে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মানবিক সহায়তা কিংবা ঋণের কোনো আবেদন এখনও আমি পাইনি। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো নির্দেশনাও আমার কাছে আসেনি। নির্দেশনা পেলে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

বৈদেশিক মুদ্রা রেমিটেন্স

বিজ্ঞাপন

আদানি গ্রুপের নতুন সংকট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর