ঢাকা: মো. আশরাফুল আলম। গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব)। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ঘুষ নিয়ে এবং ‘ঘনিষ্ঠ’ ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ তার নামে রয়েছে অনেক আগে থেকেই। নামে-বেনামে দেশেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্নীতির চূড়ায় উঠে আসেন।
এমন নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আশরাফুল আলমের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ বলে জানা গেছে। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঢেলে সেই মামলা বন্ধের প্রক্রিয়া আশরাফুল চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, চার দলীয় জোট সরকারের আমলের ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি অন্যতম সহযোগীও ছিলেন আশরাফুল— রয়েছে এমন অভিযোগও।
এতসব অভিযোগের পরও বহাল তবিয়তে নিজ পদে রয়েছেন মো. আশরাফুল আলম। তাতে করে গণপূর্তের বিভিন্ন প্রকল্পে কেবল সংশ্লিষ্ট বিভাগে দফায় দফায় অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পাননি ঠিকাদাররা। এ কারণে এবার তারা বাধ্য হয়ে আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব থেকে শুরু করে এই অভিযোগ তারা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। এমনকি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়েও এই অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। ওই অভিযোগপত্র ও তার সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন নথি সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা পান কুমিল্লা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মের্সাস কাজী শাহ ইসলাম কনস্ট্রাকশন। অসাধু উপায়ে এই প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নির্মাণের কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন আশরাফুল আলম। অভিযোগ আছে, মানহীন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে ওই ইনস্টিটিউট নির্মাণের কাজ এগিয়ে গেলেও কায়কোবাদ বা তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি আশরাফুলের হস্তক্ষেপেই।
পরে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ১৩ ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সেই সুপারিশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। অভিযোগে বলা হয়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি কায়কোবাদ এখন মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। এবং এখনো তার সঙ্গে আশরাফুলের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে।
ঘুষের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার কার্যক্রম আশরাফুল ধানমন্ডিতে পিডাব্লিউডি’র কার্যালয়ে বসে সম্পন্ন করেন বলে অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। ওই কার্যালয়কে তারা ‘হাওয়া ভবন-২’ হিসেবে আখ্যা দেন। বলেন, বিকেলের পর থেকে সেই কার্যালয়ে বসেই বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ ‘ডিস্ট্রিবিউশন’ করেন তিনি।
এর আগে একাধিক জাতীয় দৈনিকে আশরাফুল আলমের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (রংপুর) এবং ঢাকায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে নিযুক্ত থাকার সময়েই ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিল আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে। এসব প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে অভিযোগে বলা হয়, প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে আশরাফুল আলমের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল অর্থ-সম্পদ অর্জনের তথ্য পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশে-বিদেশে এমন সম্পদের তথ্যের বিষয়ে জানতে চেয়ে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে নোটিশও দিয়েছিল দুদক। সে জবাব না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়াও ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু কোটি কোটি টাকা খরচ করে সেই প্রক্রিয়াকেও আশরাফুল আলম থামিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, এখনো আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক।
কেবল ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার বিষয়ে নয়, অধিদফতরের পিয়ন, কেরানি থেকে শুরু করে নির্বাহী প্রকৌশলী পর্যন্ত বিভিন্ন পদের ‘বদলি বাণিজ্যে’র ক্ষেত্রে আশরাফুল আলম প্রধান হোতা বলে উল্লেখ করেছেন অভিযোগকারীরা। তারা লিখিত অভিযোগে বলছেন, তাকে ‘সালামি’ দিয়ে ‘সন্তুষ্ট’ না করা পর্যন্ত পিডাব্লিউডি’র কোনো প্রকৌশলীই নিজ কর্মস্থলে ‘নিরাপদ’ নন। এই করোনাভাইরাসের সংকটকালেও টাকার বিনিময়ে পোস্টিং ও বদলির কার্যক্রম থেকে দমিয়ে রাখা যায়নি তাকে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত ৮০ জন প্রকৌশলী, উপপ্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলীর বদলির পেছনেও তিনিই মূল ভূমিকা পালন করেছেন। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়েও অন্যদের ওপর চাপ তৈরি করা ও সুবিধা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তার নামে।
এসব অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগকারীরা আবেদন করেছেন, চলতি দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদফতরের এই প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো যেন যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা হয়।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছাড়াও গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, সেনাবাহিনী প্রধান, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে এই অভিযোগপত্র। এছাড়া আর্থিক দুর্নীতি-অনিয়ম ও অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন সম্পর্কিত বিভিন্ন অভিযোগ পাঠানো হয়েছে দুদকেও।
জানতে চাইলে এ অভিযোগ পেয়েছেন বলে সারাবাংলার কাছে স্বীকার করে নেন দুদক পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে চাননি তিনি।
নানামুখী এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় অভিযুক্ত মো. আশরাফুল আলমের সঙ্গেও। তবে দফায় দফায় ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তার মোবাইল নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে যোগাযোগ করা হয় প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের মিডিয়াউইং কর্মকর্তা কল্যাণ কুমার কুণ্ডুর সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে জানান, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।