Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অনলাইন জুয়ার ফাঁদে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, ঢাকার টাকা যায় শিলংয়ে!


১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:০৫

ঢাকা: ক্যাসিনো ছিল টাকাওয়ালা ধনাঢ্য মানুষদের চিত্ত-বিনোদনের জায়গায়। সেখানে টাকাওয়ালারা অভিজাত জুয়ার ফাঁদে পড়ে খুঁইয়ে আসতো কোটি কোটি টাকা। গত বছর ক্যাসিনোগুলোতে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের পর বর্তমানে সেগুলো বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এবার অনলাইন জুয়া বা ‘তীর খেলা’র ফাঁদে পড়েছে রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলার খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী। ৭০ গুণ লাভের আশায় প্রতিদিন নিঃস্ব হচ্ছেন হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ। আর এই জুয়ার লাভের টাকা ভাগ বাটোয়ারার পর একটি অংশ চলে যাচ্ছে ভারতের শিলংয়ে। কারণ অনলাইন এই জুয়া সেখান থেকেই পরিচালিত হয়।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান ও নেত্রকোনা থেকে অনলাইন জুয়ার বাংলাদেশি মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অর্গানাইজড ক্রাইম ডিভিশন। আসামিরা রিমান্ডে বলেছে, ‘অনলাইনে জুয়া খেলার টাকা সিলেট হয়ে চলে যায় ভারতের শিলংয়ে।’

শনিবার (২৯ আগস্ট) ডিবির অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) মো. নাজমুল হক সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া খেলার মূলহোতাদের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাকৃতরা হলো- মো. শামীম মিয়া (৩০), আবদুল আলী (৩১), এরশাদ মিয়া (২৯) ও সোহাগ মিয়া (২৭)। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা গত দুই বছর ধরে সারাদেশেই সক্রিয়। জুয়াড়ি, সেলসম্যান ও এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এই জুয়া।’

গ্রেফতারের সময় জুয়ারিদের কাছ থেকে জুয়ার কাজে ব্যবহৃত ছয়টি মোবাইল, একটি রেজিস্ট্রার খাতা, ১-৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিশিষ্ট চারটি চার্ট সংবলিত ব্যবহৃত শিট এবং পাঁচটি অব্যবহৃত চার্ট সংবলিত শিট জব্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে ডিবি।

অনলাইন জুয়া তীর টুডে ডটকম

ডিবির ভাষ্য, সারাদেশেই ‘তীর টুডে ডটকম’র এজেন্ট ও সেলসম্যান রয়েছে। ভারতের শিলং থেকে এ জুয়া পরিচালিত হয়। সেখানে ৭০ গুণ লাভ দেওয়া হলেও বাংলাদেশে ৮০ গুণ লাভ দেওয়া হয়। একজনের একাধিক সংখ্যাও কেনার সুযোগ রয়েছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে চলছে এই জুয়া খেলা। দিনমজুর, ট্রলি ড্রাইভার, কয়লা শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ীসহ স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে জুয়ার এজেন্টরা। চক্রটি প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিজয়ীরা লাভবান হলেও অসংখ্য মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। গত দুই বছরে চক্রটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জুয়া খেলার মাধ্যমে অর্জিত টাকা অনলাইন ব্যাংকিং সেবা বিকাশের মাধ্যমে চক্রের বিভিন্ন মহলে লেনদেন হয়। এই টাকার একটি অংশ বিভিন্ন হাত ঘুরে চলে যায় ভারতের শিলংয়ে জুয়া পরিচালনাকারীদের কাছে।

বিজ্ঞাপন

যেভাবে ও যাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিস্তার

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গোহাটি এলাকা থেকে চালু হয় এই অনলাইন জুয়া তীর খেলা। এরপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সিলেটের বিভিন্ন প্রান্তে। সিলেটের অনেককে সর্বশান্ত করে জুয়াটি বিস্তার লাভ করে নেত্রকোনা জেলায়। এর পর নেত্রকোনা হয়ে শিলং তীরের থাবা পড়েছে রাজধানীতে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি বিশ্লেষণ করে গত ২৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৫টায় গুলশান থানার কালাচাঁদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনলাইনে শিলং তীর জুয়ার এজেন্ট শামীম ও আবদুল আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে পরদিন সকাল ৮টায় নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানার বরুয়াকোনা বাজার থেকে এজেন্ট এরশাদ ও সোহাগকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা থেকে এজেন্টরা বিকাশের মাধ্যমে এরশাদ ও সোহাগের কাছে টাকা পাঠাত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

জুয়ার মাধ্যমে যেভাবে হাতিয়ে নেয় টাকা

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ভারতের শিলংয়ের জুয়াড়িরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশি এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেলসম্যান নিয়োগ করে। এই সেলসম্যানদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখিয়ে শিলং তীর জুয়ায় আসক্ত করা হয়। ভারতের শিলংভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘তীর টুডে ডটকম’ ব্যবহার করে ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত নম্বরগুলো বিক্রি করা হয়। ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নম্বরগুলো যারা কেনে তাদের সঙ্গে সেলসম্যানরা যোগাযোগ করে। তখন জুয়াড়িরা সেলসম্যানের কাছে নম্বর ও বিভিন্ন অংকের টাকা দেয়। সেলসম্যানরা বিক্রিত এ নম্বরের বিপরীতে টাকা দেয় এজেন্টের কাছে।

ভারতের শিলংয়ে রোববার ব্যতীত সপ্তাহে দুবার জুয়ার ড্র অনুষ্ঠিত হয়। ড্রতে ১ হতে ৯৯-এর মধ্যে একটি নম্বর বিজয়ী হয়। যে ওই নম্বরটি কিনেছিল তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিজয়ীরা নম্বরের ক্রয়মূল্যের ৮০ গুণ টাকা এজেন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় একজন বাদে সবাই পুঁজি হারিয়ে ফেলে। জুয়াড়ি, সেলসম্যান ও এজেন্টের মধ্যে সব লেনদেন সম্পন্ন হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে। সেলসম্যানরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন রেখে বাকি টাকা ঢাকার এজেন্ট শামীম ও আবদুল আলীর কাছে পাঠায়। এরপর শামীম ও আলী তাদের কমিশন রেখে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা নেত্রকোনার এজেন্ট এরশাদ ও সোহাগের কাছে পাঠায়। নেত্রকোনা থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা চলে যায় সিলেটের জাফলংয়ে। জাফলং থেকে টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতের শিলংয়ে চলে যায়। এভাবে প্রতিদিন এ চক্রটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এ পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) আইনে মামলা করা হবে। ডিবি জানায়, প্রথমে রাজধানী থেকে চক্রের হোতা শামীম ও আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নেত্রকোনার দুর্গম এলাকা থেকে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ চক্রের সঙ্গে আর কারা জড়িত রয়েছে সে বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

অনলাইন জুয়া এজেন্ট ক্যাসিনো তীর টুডে ডটকম দরিদ্র জনগোষ্ঠৗ ভারতের শিলং সেলসম্যান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর