‘খেলাপি ঋণের চিত্র উদঘাটন হলে ব্যাংকগুলো কঙ্কালে পরিণত হবে’
২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩১
ঢাকা : চলতি বছরের জুন মাস শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা টাকা। সর্বশেষ তিন মাসে অর্থাৎ গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকিং খাতে নতুন করে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
তবে খেলাপি ঋণের এই পরিমাণকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। তাদের মতে, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সময়ে ঋণ পূনঃতফসিল করে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছে। দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র আড়ালে চলে যাচ্ছে। প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করা হলে ব্যাংকগুলো কঙ্কালে পরিণত হবে বলেও তাদের অভিমত।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থউপদেষ্টা ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা ভয়াবহ। কারণ যখন নিয়ম নীতি না মেনে ঋণ পূনঃতফসিল করছে তখন ঋণগুলো খেলাপির তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আর ঋণের রি-সিডিউলের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কাগজে কলমে কমে এলেও বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, বর্ধিত সময়ের মধ্যেও কিস্তি পরিশোধ না করলেও নানা ধরনের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ যে পরিমাণে দেখানো হচ্ছে, এই সংখ্যাটা গ্রহণযোগ্য নয় বরং প্রশ্নবিদ্ধ।’
মির্জা আজিজ আরও বলেন, ‘অনেক ব্যাংক তাদের নির্ধারিত সীমার বেশি ঋণ দিচ্ছে। এসব ঋণের একটা বড় অংশ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ফলে যে সব ব্যাংক সীমার বেশি ঋণ দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিৎ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কত সেটি কার্পেটের নিচে রয়েছে। কার্পেট উঠালে আসল তথ্য জানা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাতে যেন খেলাপি ঋণ না বাড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাধিকবার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তারপরেও খেলাপি ঋণ কমছে না, বরং বাড়ছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ লুকিয়ে না রেখে তা প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতের আসল সমস্যাটা এখনো উদঘাটিত হয়নি। সেটা হলো খেলাপি ঋণ। এর প্রকৃত চিত্র উদঘাটিত হলে তা অনেক ভয়াবহ হবে। ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের একটা বড় অংশের ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা নেই অথবা তারা দিচ্ছে না কিংবা দেবে না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনে খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করলেও কিছু করার নেই। শুধু মাত্র ঋণের টাকা পুনরায় নতুন করে ঋণ হিসেবে দেখিতে দিতে পারবে। বর্তমানে সেটাই করা হচ্ছে। তবে এভাবে তো আর চিরকাল চলতে পারে না। হয়ত আগামী এক/দেড় বছর পর যখন এটি ধরা পড়বে তখন ভেতর থেকে সব কঙ্কালগুলো বেরিয়ে আসবে। সমস্যার গভীরতা তখন টের পাওয়া যাবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বর্তমানে যে খেলাপি ঋণের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে খেলাপি ঋণ অনেক অনেক বেশি। তবে সেটা কত বেশি তা আমরা জানি না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রফিট বিতরণ, লভ্যাংশ বিতরণ বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্তমানে এমন কিছু ব্যাংক রয়েছে যেগুলো টিকে থাকার কথা না। তারপরেও সেগুলো কিভাবে টিকে আছে, আমি জানি না। কিছু ব্যাংক যদি দেউলিয়া হয়ে যায় তখন কী হবে?’
তিনি বলেন, গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এটা কিছুই নয়। যখন চাদরের নিচে লুকায়িত সব খারাপ ঋণ বের করা হবে। পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তখন তা বোঝা যাবে।
এইক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কী করনীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এইক্ষেত্রে সরকারের কোনো করনীয় আছে বলে মনে হয় না। সরকারের করণীয় হলো কিছু মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করা! খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদি আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এসএমই খাতে ঋণ বিতরণে দ্রুত ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতে করে সরকারের নীতির কিছু সমসা আছে।বর্তমান ৯ শতাশ সুদে এসএমই খাতে্ ঋণ বিতরণ করা যাবে না। এটা ১২ শতাংশ করতে হবে। পাশাপাশি বাংক খাতে বড় ধরনের প্রভিশন করতে হবে।’
কিছু দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভালো ব্যাংক আর কয়টা আছে? আর থাকলেও কেন সেগুলো দুর্বল ব্যাংককে টানবে? এতে করে তারা নিজেরাও আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। এক কানা কীভাবে আরেক কানাকে পথ দেখাবে?’
উল্লেখ্য করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোকে নানা সুযোগ সুবিধা দিলেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। ফলে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সর্বশেষ গত ৩০ জুন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা এক প্রতিবেদন এ চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৪ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।যা মোট ঋণের ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।