সন্তানের দাফন শেষ করেই পেলেন স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ
৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৫৯
ঢাকা: প্রতিদিনের মতো গত শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) বাবা জুলহাসের (৩৫) সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের তল্লারবাগ বাইতুর মামুর মসজিদে এশার নামাজ পড়তে গিয়েছিল জুবায়ের ওরফে জুয়েল (৭)। কিন্তু হঠাৎ বিস্ফোরণে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। বিস্ফোরণের পর অন্যান্যদের সঙ্গে বাবা-ছেলেকেও নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। ভর্তি করা হয় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। জুবায়ের আর তার বাবাসহ সেখানে তখন গুনে গুনে ৩৭টি পোড়া দেহ এসে জমেছে। একদিনে আগুনে পোড়া এত রোগী এর আগে কখনো দেখা যায়নি এই হাসপাতালে।
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট তখন দগ্ধ শরীরগুলোর স্বজনদের হাহাকার আর চোখের জলে সিক্ত। চিকিৎসক ও নার্সসহ সবার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে সেদিনই রাত সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেল জুবায়ের। এরপর একে একে আগুনে পোড়া শরীরগুলো পরিণত হতে থাকে একেকটি মরদেহে। দেখতে দেখতে সেই তালিকায় যোগ হয় আরও ২৩ জন। এরই মধ্যে রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন জুবায়েরের বাবা জুলহাস। মাত্র ৩২ ঘণ্টার ব্যবধানে সন্তানের পর স্বামীকেও হারিয়ে শোকস্তব্ধ রহিমা বেগম।
সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কথা হয় রহিমা বেগমের স্বজন নাদিম হাসান শাকিলের সঙ্গে। শাকিল সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাহিমা বেগম শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে সন্তান জুবায়েরের মরদেহ নিয়ে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলায় রওনা হন। যখন জুবায়েরের মরদেহ বুঝে নিচ্ছিলেন, ঠিক ওই সময় স্বামীকে নেওয়া হচ্ছিল আইসিইউতে। এরপরেও সবকিছু সহ্য করে সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠেন তিনি।’
শাকিল বলতে থাকেন, ‘সন্তানের মরদেহ নিয়ে ভোর ৫টার দিকে রাঙ্গাবালীতে পৌঁছান রহিমা বেগম। রোববার সকাল ৬টার দিকে দাফন হয় জুবায়েরের। সন্তানকে কবরে রেখে স্বামীর পাশে থাকতে রহিমা বেগম ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি রওনাও দিতে পারেননি, তার আগেই স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পান। জুলহাসের মরদেহ নিয়ে রাঙ্গাবালীর উদ্দেশে আমিই রওনা হচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘রহিমার তো কেউ থাকল না। সংসারের উন্নতির জন্য শিশুসন্তানকে রাঙ্গাবালীতে দাদীর কাছে রেখে স্বামী-স্ত্রী মিলে নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। কে জানে, এমন একটি ঘটনায় ছেলে ও স্বামীকে হারাতে হবে। সব হারিয়ে রহিমা এখন নির্বাক।’
এর আগে শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রহিমা সন্তানের মরদেহ বুঝে নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘জুবায়ের রাঙ্গাবালীতে দাদীর কাছে থাকত। কয়েকদিন হলো মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছিল। বাবার নামাজে যাওয়া দেখে ছেলেও বায়না ধরে। না পেরে বাবা ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। গার্মেন্টস থেকে ফিরে জুলহাস ওই মসজিদে প্রতিদিন এশার নামাজ আদায় করত। ছেলেও যেত সঙ্গে।’
রহিমা বলছিলেন, ‘সময় কম থাকায় ওই দিন জুলহাস ছেলেকে নিয়ে যেতে চায়নি। আমিই নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করি। এরপর সে ছেলেকে নিয়ে মসজিদে যায়। মসজিদে আগুন লেগেছে শুনে সেখানে ছুটে যাই। গিয়ে শুনি, আমার ছেলে আর স্বামীকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, ঢাকায় বার্ন ইউনিটে নেওয়া হয়েছে। সবশেষ পরিণতি, আমার ছেলে আর কথা বলবে না। কোনোদিন মায়ের কাছে আর বেড়াতে আসবে না।’
শুক্রবার রাতে ওই মসজিদেই দগ্ধ হয়েছিলেন ইমরান হোসেন (৪০)। আইসিইউতে ভর্তি আছেন। হাসপাতালে রোববার কথা হচ্ছিল তার দুই ভাইবোনের সঙ্গে। ভাই জাকির হোসেন বলেন, ‘কাছেই মসজিদ হওয়ায় প্রতিদিন তারা সেখানেই জামাতে নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষ হয়েছিল। অনেকেই চলে গিয়েছিলেন, কয়েকজন সুন্নত নামাজ আদায় করছিল। এমন সময় বিকট শব্দে মসজিদের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটে।’
ইমরানের বোন শিল্পী আক্তার বলেন, ‘আজ সকালে স্যুপ খেয়েছে। এরপর তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। তার শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। ডাক্তার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলেছেন।’
ইমরানের বাবার নাম আলম শেখ। তাদের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়। নারায়ণগঞ্জে ইমরান ফকির নিট গার্মেন্টসে চাকরি করতো। তার স্ত্রীসহ এক ছেলে রয়েছে।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত যে ১৩ জন ভর্তি আছেন শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাতে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এরই মধ্যে ওই ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংসদে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের কারণ খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।