ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় দগ্ধদের পরিবার
৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:০৮
ঢাকা: ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কৃষক ফরিদ (৫৫)। নারায়ণগঞ্জে ভাই ও মেয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাম জামে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে তিনিও দগ্ধ হয়েছেন। বর্তমানে তিনি শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।
ফরিদের স্ত্রী রিনা (৪৫) সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক কাঠা জমিও নেই আমাদের। পরের জমিতে কাজ করতেন তিনি। অন্যের জমি বর্গা করে যে আয় হতো তা দিয়েই সংসার চলতো। দগ্ধ হওয়ায় এখন তিনি যদি দুই তিন মাস ঘরে পরে থাকেন তাহলে আমাদের দেখার মতো কেউ থাকবে না। পাশে দাঁড়াবে এমন কেউও নেই। আর আমাদের এই কষ্ট বোঝানোর কোনো ভাষা নেই।’
রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে কান্নাজরিত কণ্ঠে এভাবেই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কথা জানালেন আহত ফরিদের স্ত্রী রিনা। রিনার মতো আরও অনেক স্বজনের চোখ এখনও অশ্রুসিক্ত। ভবিষ্যৎ ভাবনায় অনেকেই দিশেহারা। শুধু সংসার নয়, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া খরচ বহন নিয়ে এখন শঙ্কায় দগ্ধদের পরিবার।
উদ্বিগ্ন ফরিদের বড় ছেলে মো. রায়হানও। সে ত্রিশালের একটি কাওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। সারাবাংলাকে রায়হান বলেন, ‘সংসারের দায়িত্ব আব্বুর ওপরই ছিল। মাওলানা লাইনের এই লেখাপড়া শেষ হতে আরও ছয় বছর লাগবে। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণিতে। তারও তো লেখাপড়া আছে। আরেকটা ছোট বোনও আছে। সব মিলিয়ে মনে হয় লেখাপড়া ছাড়তে হবে। কোনো একটা উপায়ে হাল ধরতে হবে সংসারের।’
আরেক দগ্ধ আমজাদের (৩৭) স্ত্রী তানজিলা (২০) বলেন, ‘উনি ফকিরা গার্মেন্টেসে কভার্ড ভ্যান চালাতেন। তল্লাতেই আমাদের বাসা। ওইদিন সারাদিন বাসাতেই ছিল। বাসাতেই মাগরিবের নামাজ পড়েছিল। আমার এক মেয়ে। তাকে এবার প্লেতে ভর্তি করিয়েছিলাম। উনার দুই হাত পিঠ ও মাথা দগ্ধ হয়েছে। ওনার এই অবস্থায় ভেতরের কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে।’
দগ্ধ আমজাদের বাবা আব্দুল আহাদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ওরে এখন দেখলেই মনে হয় আমি পৃথিবীতে আর নাই। বাবা হিসেবে এই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। অনেক আগেই বড় ছেলে পৃথক হয়ে গেছে। এই ছেলেই আমাদের সংসার চালাতো। আমার বয়স হওয়ায় ছেলের আয়েই সংসার চলছিল। ও দগ্ধ হওয়ার দুই ঘণ্টা আগেও বিকাশে আমাকে টাকা পাঠাইছিল।’ এসময় ছেলের সুস্থতায় তিনি সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন।
একই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা আজিজ (৪৫) দগ্ধ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি। তল্লার ওই মসজিদের সঙ্গেই তার লন্ড্রির দোকান ছিল। আজিজের স্ত্রী আছমা বেগম (৩৪) সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুই জনই মাদ্রাসায় পড়ে, কারো লেখাপড়া শেষ হয়নি। ওনার লন্ড্রির দোকানের আয় দিয়েই সংসার চলতো। ছোট বেলা থেকেই হাতে পায়ে সমস্যা থাকায় তিনি দৌঁড়াতেও পারেননি। হয়তো তাই মসজিদের বাইরে থাকলেও তিনি দগ্ধ হয়েছেন। সংসার কিভাবে চলবে এখন তা উপরওয়ালার ফয়সালা।’
এদিকে, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় দগ্ধ আবুল বশর (৫২) রোববার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার স্ত্রী তাজিয়া বেগম (৪০) সারাবাংলাকে বলেন, ‘কমুদ্দিন ফার্মাতে উনি মেশিন অপারেটর পদে চাকরি করতেন। থাকতেন কোয়ার্টারে, তল্লার ওই মসজিদেই নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। পরিবারে একমাত্র তিনিই আয় করতেন। উনি আর নাই, এই কথা মনে হলেই মন আউলাইয়া যায়। বড় ছেলের লেখাপড়া শেষ হয়নি, তিন মেয়েও ছোট। ছোট আরেকটা ছেলেও আছে। কীভাবে চলবো তা নিয়েই শঙ্কায় আছি।’
আবুল বশরের বড় ছেলে অনার্স পড়ুয়া হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনকারী। দুই ভাই ও তিন বোনের খরচ উনাকেই বহন করতে হতো। অবস্থা ভালো না থাকায় ইন্টার পাসের পর চাকরি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবার স্বপ্ন ছিল আমি উচ্চ শিক্ষিত হবো। তাই তিনি আমাকে চাকরি করতে দেননি। কিন্তু এখন তো কিছু একটা করতেই হবে।’
নারায়ণগঞ্জের মসজিদে এসি বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় এখনও ১২ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে ৬ জন আইসিসিতে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই ১২ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নন।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন রোববার সাংবাদিকদের জানান, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরেণের ঘটনায় দগ্ধ মোট ৩৭ জনের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন ১২ জন চিকিৎসাধীন আছে। তাদের অবস্থাও শঙ্কামুক্ত নয়। দগ্ধ ১২ জন রোগীর মধ্যে পাঁচ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে দগ্ধ চিকিৎসাধীন ১৩ রোগীরা হলেন- ইমরান (৩০), মামুন (২৩), আমজাদ (৩৭), আ. সাত্তার (৪০), হান্নান (৫০), আ. আজিজ (৪০), রিফাত (১৮), নজরুল ইসলাম (৫০), মো. কেনান (২৪), মনির ফরাজি (৩০), শেখ ফরিদ (২১) ও মো. ফরিদ (৫৫)। এদের মধ্যে ফরিদ, মনির ফরাজি, কেনান, আজিজ, আমজাদ আইসিইউতে রয়েছেন।