‘সর্ষের মধ্যে ভূত থাকাতেই অর্থ পাচার রোধ করা যাচ্ছে না’
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৪
ঢাকা: কানাডা-অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব অর্থ পাচার রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থপাচারে সহায়তাও করেছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টরা নিজেরাও বিদেশে অর্থপাচার করেছেন। আবার অনেক সংস্থার কেউ কেউ ঘুষ ও উৎকোচের বিনিময়ে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন। সর্ষের মধ্যে ভূত থাকার কারণেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) অনলাইন নিউজ পোর্টাল সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এসব কথা বলেন। সারাবাংলা ফোকাসের এ পর্বের আলোচ্য বিষয় ছিল ‘কানাডার বেগম পাড়া’। সারাবাংলা ডটনেটের বিশেষ প্রতিনিধি এমএকে জিলানীর সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন কানাডা প্রবাসী ও কানাডা থেকে প্রকাশিত নতুন দেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর এবং কানাডা প্রবাসী টেলিকম প্রকৌশলী রাজিবুর রহমান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অবৈধ টাকা পাচার রোধে বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাজ করার কথা। কিন্তু তারা কেউ ওইভাবে কাজ করছেন না। এমনও শোনা যায়— যারা বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সংস্থার সঙ্গে জড়িত, তারাও বিদেশের বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছেন। ফলে টাকা পাচারকারীদের ধরবে কে? সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে, তাহলে তাকে কে সরাবে? বিদেশে টাকা পাচার এবং কালো টাকা উপার্জন করার ক্ষেত্রে আমরা বেশ শক্তিশালী হলেও টাকা পাচার রোধ করার ক্ষেত্রে আমরা সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে বেশ দুর্বল।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র হলো একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের যেসব ব্যক্তি কাজ করছেন, তাদের ওপর রাষ্ট্রকে নির্ভর করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মধ্যে অর্থ পাচার রোধে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারা যদি সত্যিকার অর্থে কমিটমেন্ট নিয়ে কাজ করেন, তাহলে অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব। অথচ প্রায়ই শোনা যায়— এই সংস্থাগুলোতে যারা কাজ করেন, তাদের কেউ কেউ নিজেরাও কালো টাকা উপার্জন করে বিদেশে পাচার করছেন। আবার ঘুষ ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করার সুযোগ দিয়ে দিচ্ছেন বলেও জানা যায়।
তিনি বলেন, সুইজারলান্ডের একটি সংস্থা বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জিডিপির কমপক্ষে ৩০ শতাংশ অর্থ কালো টাকা। অবৈধভাবে আয় করা অর্থ কিংবা বৈধভাবে আয় করেছে, কিন্তু ট্যাক্স দেয়নি। এই দুই অর্থের পারিমাণ মিলে জিডিপি‘র ৫০ শতাংশ অর্থ কালো টাকা হতে পারে!
সুশাসনের অভাবের কারণেই কালো টাকা ঠেকানো যাচ্ছে না জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গর্ভনর বলেন, বাংলাদেশে সুশাসনের অবস্থা এতই খারাপ যে আমরা কালো টাকা উৎপাদন ঠেকাতে পারছি না। কালো টাকার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে যারা সাদা টাকা উৎপন্ন করে, এক সময় তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে। কালো টাকার একটি বড় অংশই অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা। এ কারণে কালো টাকা দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেন না। ফলে কালো টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এদিকে, যেসব দেশে টাকা পাচার করা হয়, তারা কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। কিন্তু দুর্বল হয় আমাদের দেশের অর্থনীতি। এ কারণেই সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া কানাডায় অর্থ পাচার হলে সেসব দেশের সরকার বিষয়টি অনেকটা ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছে। কিন্তু এদিকে আমরা দিন দিন গরীব হয়ে যাচ্ছি।
খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ইনভয়েসিং ও আন্ডার ভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও টাকা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। এমনকি ব্যাংকগুলোও সেভাবে কাজ করছে না। দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে, আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তা জানে না— এ বিষয়টি আমি বিশ্বাস করি না। ফলে তারা এই অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি দেশ থেকে অর্থ পাচার রোধে রাষ্ট্রের পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট দরকার। বিভিন্ন রাজনৈতিদক দলের ওপরের লেভেলের লোকজন যদি বেগম পাড়ায় বসবাস করেন, তাহলে কে ব্যবস্থা নেবেন? অর্থাৎ সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে কিভাবে তাড়ানো যাবে? এই ভূত কে তাড়াবে— এই প্রশ্ন রাখলাম।
পিকে হালদারের প্রসঙ্গ টেনে খন্দকার ইব্রাহিম বলেন, তিন-চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেই প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে এবং বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই ঘটনার মূল নায়ক পিকে হালদার। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুর অথবা কানাডায় পালিয়ে আছেন। তাকে ধরে নিয়ে আসতে পারলে অর্থ পাচারের অনেক ঘটনা জানা যেত। এ বিষয়ে প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু কেন তারা পিকে হালদারকে ধরেনি, সেটা আমার মাথায় আসে না। তিনি তিন-চার বছর ধরে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা সহায়তা করেননি— এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। ফলে সর্ষের মধ্যে ভূত রয়েছে— এটাই হলো সবচেয়ে বড় কথা।
কানাডা প্রবাসী এবং কানাডা থেকে প্রকাশিত নতুন দেশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর বলেন, কানাডায় বেগম পাড়া নামে বাস্তবে কোনো জায়গা না থাকলেও এটি দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের ভয়াবহতা বুঝাতে একটি প্রতীকী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে এই শব্দটি সারাবিশ্বের বাঙালিদের কাছে একটি পরিচিত শব্দ।
তিনি বলেন, কানাডা এমন অনেক পরিবার থাকেন, যারা কোনো চাকরি-বাকরি করেন না। তারপরও তারা কানাডায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। এই পরিবারগুলো ৮ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার দামের বাড়ি কিনে বসবাস করছেন। আমরা অনুসন্ধান করে দেখলাম, এই পরিবারগুলো কানাডায় বসবাস করলেও তাদের খরচের টাকা বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়। এই টাকাগগুলো মূলত পাচার হয়ে এখানে আসে।
তিনি বলেন, অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। এসব সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে বিদেশে চলে আসছে, তা আমি একজন অর্থনীতির রিপোর্টার হিসাবে বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা পাচার হচ্ছে। কিন্তু পাচারকারীরা কানাডা সরকারকে বাংলাদেশ থেকে আনা এসব টাকা বৈধ হিসেবে প্রদর্শন করছে। এর সপক্ষে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের এজেন্সিগুলো কেন তাদের ধরতে পারছে না— সেটাই এখন কানাডায় আলোচিত একটি বিষয়।
কানাডা প্রবাসী টেলিকম প্রকৌশলী রাজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা অবৈধভাবে টাকা পাচার করে কানাডায় নিয়ে আসছে, তারা আলিশান জীবনযাপন করছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কারণ আমরা কানাডায় ভালো চাকরি করেও টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনতে পারছি না। অথচ তারা কোনো কাজ না করেও ৭ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারে বাড়ি কিনছেন। এসব বিষয় নিয়ে আমরা ‘লুটেরা রুখো, স্বদেশ বাঁচাও’ স্লোগানে কানাডাতে আন্দোলনও করেছি।
অর্থ পাচার কালো টাকা খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশে অর্থ পাচার বেগম পাড়া রাজিবুর রহমান শওগাত আলী সাগর সাদা টাকা সাবেক ডেপুটি গর্ভনর সারাবাংলা ফোকাস