থেমে নেই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার, বাড়ছে উৎপাদন
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:৪০
ঢাকা: দেড় যুগ আগে পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় পলিথিন ব্যাগ। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়ণ করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এর উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন। কিন্তু পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর হিসেবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগসহ নানান কার্যক্রম বিদ্যমান থাকলেও মিলছে না কার্যকরি কোনো সমাধান।
নিয়মিত অভিযানে জরিমানা-কারাদণ্ড অব্যাহত থাকলেও বন্ধ হয়নি রাজধানীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা কারখানায় পলিথিনের ব্যাগের উৎপাদন। উল্টো বেড়েছে আইনে নিষিদ্ধ এ পলিথিনের তৈরি ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার। কাঁচাবাজার থেকে মুদি দোকান কিংবা হকার থেকে বিপণিবিতান সর্বত্রই মিলছে পলিথিন ব্যাগ। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। তেমনি ক্যান্সারসহ নানা রোগের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে নিষিদ্ধ এ পলিথিন ব্যাগ।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৯০-৯৫ ভাগ মানুষ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে অবগত। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের বিকল্পে সহজলভ্য কোনো কিছুই না থাকায় এটির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ। এজন্য অবৈধ উৎপাদন বন্ধ, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থাপনা, পলিথিনের বিকল্প পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য ও সুলভ মূল্য না হওয়া এবং বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারে মানুষের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি না করাকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, পলিথিন ব্যাগের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। ক্যান্সার, কিডনি, চর্মরোগ এবং বন্ধ্যাত্বসহ নানা রোগের অন্যতম কারণ পলিথিনে থাকা কেমিক্যাল। এটির লাগাম এখনই টেনে না ধরলে ভবিষ্যতে এমন নানান রোগের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হবে বলে শঙ্কা তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে বৈশ্বিকভাবে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তাই বাংলাদেশেও ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর প্রেক্ষিতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগে ব্যবহার, উৎপাদন এবং বিপনন ও পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়- যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করা হলে ছয় মাসের জেল ও জরিমানা করা হবে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি।
হাজারীবাগের বউ বাজারের মুন্না ডিপারমেন্টাল স্টোরের সহযোগী মো. রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত প্রায় ১৫ বছর ধরে দোকান কাজ করছি। ২০০৪/৫ সালের দিকে পলিথিনের এতো ব্যবহার ছিল না। তখন পলিথিন ব্যবহার করলেই জরিমানা করা হবে এ ভয়ে কেউ ব্যবহার করতো না। তখন ছিল কাগজের ঠোঙ্গা আর প্লাস্টিকের ব্যাগ। তবে প্লাস্টিকের ব্যাগ তখন কাস্টমাররা বাড়ি থেকেই নিয়ে আসতো। কিন্তু এখন আর সে চল নেই। এখন কেউ আর বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে আসে না। আমরাও সবসময় পলিথিনে দিয়ে থাকি। কারণ পলিথিনের দাম কাগজের ঠোঙ্গার চেয়ে সস্তা।’
পলিথিন আর কাগজের ঠোঙার দাম কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এক কেজি পলিথিন দেড়শ টাকা। কখনও ১০-২০ টাকা কম বেশি হয়। কিন্তু এই এক কেজিতে দুই আড়াইশ পলিথিন থাকে। কিন্তু একই টাকায় যদি ঠোঙা কিনি তবে তাতে বড়জোর ৭০-৮০টা ঠোঙা থাকে। তাই পলিথিনে লাভ বেশি আমাদের।’
একই কথা বললেন বুয়েট মার্কেটের কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা নুরুল হক। পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং এ সংক্রান্ত আইনের বিষয়ে তাকে জানালে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ শাক সবজি থাকে পানিতে ভেজা। তাই এজন্য আমরা পলিথিন ব্যবহার করি। কিন্তু সরকার যদি এটা বন্ধই করে, তাহলে কি কারো সাধ্য আছে এটা ব্যবহার করার?’
রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, চকবাজার, হাজারীবাগ, ইমামগঞ্জ, আরমানিটোলা, চানখারপুল, সোয়ারীঘাট, কেরানীগঞ্জ এবং কামরাঙ্গীরচরসহ আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে হাজারখানেক ছোট ও মাঝারি ধরণের পলিথিন তৈরির কারখানা। এসব কারখানা মূলত ছোট্ট একটি রুমের মধ্যেই চলে। যে কারণে নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থাগুলো চাইলেও অনেক সময় এসব কারখানার খোঁজ পায় না। আবার খোঁজ পেলেও তাদের রয়েছে সিন্ডিকেট সদস্য। যারা এসব কারখানা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে কিংবা রেখে পালিয়ে যেতে পারে এমন পদ্ধতিতে তৈরি করে। তবে ঠিক সুনির্দিষ্ট কতগুলো কারখানা এমন অবৈধ পলিথিন উৎপাদন করছে তার কোনো তথ্য নেই সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোতে।
ইসলামবাগ ও কামরাঙ্গীরচরের কয়েকজন পলিথিন উৎপাদনকারী মালিক জানান, বাজারে বেশি চাহিদা এবং স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভের কারণে নিষিদ্ধ এবং কঠোর আইন থাকলেও এ ব্যবসার সুযোগ সবাই খুঁজছে। তাদের মতে ১ কেজি পলিথিন উৎপাদনসহ সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩০-৪০ টাকা। কিন্তু সেটি পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। আবার খুচরা বাজারে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তাই দৈনিক তিন-চারজন শ্রমিক দিয়ে একেকজন ১০০ থেকে দেড়শ কেজি পলিথিন উৎপাদন করে থাকে। কেউ কেউ তারও বেশি উৎপাদন করে বলে জানান তারা।
তবে এসব উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ রাজধানী হয়ে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার পেছনেও অর্থ ব্যয় করেন উৎপাদনকারীরা। এসব অর্থ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের পকেটেও যায় বলে অভিযোগ মালিকদের।
পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাফ সারাবাংলাকে বলেন, প‘রিবেশ রক্ষায় আমাদের প্রতিনিয়ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তারই অংশ হিসেবে পরিবেশের ক্ষতিকারক পলিথিন উৎপাদনকারী কারাখানাগুলোকে বন্ধের জন্য আমরা অভিযান চালাচ্ছি। অভিযানে দেশব্যাপী আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা হল সারাবাদেশে ছড়িয়ে পড়া পলিথিনের অধিকাংশই উৎপাদন হয় পুরান ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায়। কিন্তু এসব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে আমাদেরকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের নেতাকর্মীরা বাধা দেয়। এর কারণ হলো সরকার পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও ৫৫ মাইক্রোনের অধিক পলিথিন জাতীয় পণ্য বা মোড়ক উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে। এ সুযোগটা তারা কাজে লাগিয়ে অনুমোদিত কাঁচামাল আমদানি করে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন করে। কারণ বাজারে সদাই কেনার সময় যে পলিথিন দেওয়া হয় সেটির কাঁচামাল আমদানির কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু উৎপাদন ঠিকই হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর কারণ হলো অনুমোদিত কারখানার মালিকরাও ছোটখাটো কারখানাগুলোর কাছে পলিথিনের ব্যাগ তৈরির কাঁচামাল অর্থের বিনিময়ে সরবরাহ করে। আবার কেউ কেউ তাদের প্লাস্টিক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাঁচামালগুলো রিসাইকেল করে পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছে। যে কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমানে উৎপাদন নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হয়। ঠিক এ বছরেও প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার কেজি পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে ৫০ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু সমস্যা হলো এসব কারখানা প্রকৃতপক্ষে ছোটখাটো একটা রুমের মধ্যেই বসানো হয়। যে কারণে অনেক সময় আমরা টের পাইনা যে ভেতরে কি হচ্ছে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ শুধু পরিবেশ অধিদফতরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রলায়সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণে এটি পুরোপুরো নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পলিথিন উৎপাদনে আইন থাকলেও সেটি কার্যকর না থাকায় এবং বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও পরিবেশবিদ ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘পলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থা বাজারে সহজলভ্য না হওয়ায় পরিবেশ সচেতন মানুষটিও পলিথিন ব্যবহার করছে নিয়মিত। অথচ পাটের তৈরি ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু সেসব সহজলভ্য নয়। দৈনিক শুধু রাজধানীতেই দুই থেকে আড়াই কোটি পলিথিন একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু এ ফেলে দেওয়া পলিথিন কি পরিমান সমস্যার সৃষ্টি করছে তা কেউ ভাবছে না। ফেলে দেওয়া এসব পলিথিন ড্রেন-নালায় পড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। আবার খাল-বিল, জলাশয় দিয়ে এগুলো গড়িয়ে পড়ছে নদী-সাগরে। এতে এসব পলিথিনে থাকা কেমিক্যাল যাচ্ছে মাছের পেটে। আর সেসব মাছ খেয়ে মানব শরীরের নানা রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে।’
এজন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পলিথিনের অবৈধ উৎপাদন বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে উৎপাদিত এলাকাগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করতে হবে। পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য ও সুলভমূল্য বাজারজাতকরণ করতে হবে এবং সেগুলো ব্যবহারে মানুষের মাঝে আগ্রহ সৃষ্টি করতে জনসচেতনতা কিংবা ফ্রি ক্যাম্পেইন করতে হবে। তাহলে পলিথিন উৎপাদন বন্ধে কার্যকরী সমাধান মিলতে পারে।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘পলিথিন হচ্ছে ক্যান্সার সৃষ্টির যে ১০টি কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি। এছাড়াও পলিথিনে থাকা সুক্ষ কণা (কেমিক্যাল) খাবারের সঙ্গে পেটের ভেতরে যায় তখন শরীরের পরিপাক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এ ব্যাহত হওয়ার কারণে বন্ধ্যাত্ব এবং ত্বকের এলার্জি জাতীয় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং পলিথিন ব্যবহারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অনেকে পলিথিন মুড়িয়ে ফ্রিজে খাবার রাখে। এটি ঠিক নয়। কারণ ওই পলিথিনে মোড়ানো খাবার রান্নার পর শরীরে চলে যায়। কিন্তু যে পলিথিনে খাবার রাখা হয়েছিল তাতে কিন্তু এক ধরণের কেমিক্যাল থাকে, যা রান্না করলেও আগুন নিষ্ক্রিয় হয় না।’
চরম ক্ষতিকর নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ পলিথিন পলিথিন পলিথিন ব্যাগ বিপণন