‘করোনায় অর্জিত উপলব্ধি কাজে লাগাতে পারলে স্বাস্থ্যখাত এগিয়ে যেত’
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:৩৬
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) সংক্রমণের শুরুতে পুলিশ, চিকিৎসক, যোগাযোগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সকলে মিলে যেভাবে কাজের একটা উদ্যম তৈরি হয়েছিল সেটি এখন আর নেই। করোনার উপলব্ধি যদি আমরা ঠিকমত কাজে লাগাতে পারতাম তাহলে দেশের স্বাস্থ্যখাতসহ টেকসই উন্নয়নে অনেকটা এগিয়ে যেতাম বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
স্বাস্থ্যখাতসহ মৌলিক সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন মূল্যবোধের জায়গায় হাত দেওয়া। এছাড়া কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন থেকে সরে আসতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না বলেও মত দিয়েছেন আলোচকেরা।
শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) ‘এখন সময়টা কেমন’ শীর্ষক সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে বক্তারা একসব কথা বলেন।
সারাবাংলা.নেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এম এ কে জিলানীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন, নতুন সময়ের প্রধান সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান, চিকিৎসাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ, সামাজ-সংস্কৃতিক সংগঠক ড. লিয়াকত আলী, বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ।
নতুন সময়ের প্রধান সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘প্যানডেমিকের সময়ে প্রিন্ট মিডিয়া সরকারের কোনো রকম সহযোগিতা পায়নি। আমি শুধু এইটুকু দাবি করেছি, সরকারের কাছে দুই বছর আগে আমাদের যে পাওনা রয়েছে সেটুকু দিলেই হবে। দান খয়রাতের দরকার নেই। সরকার দিচ্ছে না।’
এরপর তিনি বলেন, ‘এখানে আলোচনায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার র্যাংকিংয়ের তালিকায় আমরা ৮৫তম, এটি দেখলেই তো বোঝা যায় আমাদের অবস্থা কতটা ভঙ্গুর, কত দুর্বল, কত বাজে অবস্থা। রাষ্ট্রের সার্বিক ব্যবস্থায় আইনের স্বাভাবিক প্রয়োগটুকু নাই। যে যার মতো ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
এরপর তিনি বলেন, ‘আরও যে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা দরকার সেটি প্যানডেমিক পরিস্থিতি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। অনেকগুলি পরিবর্তন, সংস্কার আনা দরকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে সব অব্যবস্থাপনা উঠে এসেছে সেগুলোও কিন্তু সাময়িক জোড়াতালি দিয়ে চলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মৌলিক রীতিনীতির যে পরিবর্তন আনা দরকার সেটার কোনো উদ্যোগ নাই। প্যানডেমিক আমাদের উপলব্ধির যে সম্ভাবনা তৈরি করেছিল সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি রাষ্ট্র যখন সিদ্ধান্ত নেবে আর কোনো মিথ্যা নয়, আর কোনো বৈষম্য নয়, তাহলে সব ধরনের সংকট কেটে যাবে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সময়টা আমার কাছে মনে হয় খুবই অনিশ্চিত, এলোমেলো। যে দিকে তাকাই সেদিকেই সুশাসনের তীব্র অভাব দেখতে পাই। যদিও পরিবেশবাদী হিসেবে বলা উচিত, এখন বাতাসের অবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে। কিন্তু একজন নাগরিক হিসেবে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়েছে। যতটা আমরা নরমাল হওয়ার চেষ্টা করছি, নরমাল হওয়ার ততটা আমাদের প্রস্তুতি নেই। আক্রান্ত হয়ে গেলে সঠিক চিকিৎসা পাবো কি না সেই আতঙ্ক রয়ে গেছে। এরফলে এক ধরনের বিরক্তি, একটা অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।’
পাবলিক ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাইভেট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ তো পরের কথা, সরকারের তো পাবলিক সেক্টরেরই নিয়ন্ত্রণ নাই।’
‘জনগণের মৌলিক অধিকার কখনো প্রাইভেট সেক্টরের হাতে দিতে হয় না। মৌলিক অধিকার পূরণে প্রাইভেট সেক্টর সম্পূরক ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু মূল নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকবে। সরকার ছয়টি প্রাইভেট সেক্টরকে অনুমতি দিয়েছিল তাদের মধ্যে তিনটা প্রতিষ্ঠান কি সেবা দিয়েছে তা আমরা জানি। সেবার পরিবর্তে তারা বরং করোনার ভূয়া সনদ দিয়েছে। এতে বোঝা যায়, সরকার যা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তা তারা করতে পারে কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ে সেবার মান নিয়ন্ত্রণ করেনি।’
সব সমস্যা সমাধানের জন্য মূল্যবোধের জায়গায় হাত দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সক্ষমতা বৃদ্ধিতে হাত দিতে হবে। কর্তৃত্ব পরায়ণ শাসন থেকে সরে আসতে হবে, প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।’
ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘সময়টা স্বাভাবিক নয়, সময়টা অস্বাভাবিক। এ সময়টাই আমাদের অনেক অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এখন কিছুটা স্বাভাবিক সময়ের দিকে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আমাদের অর্থনীতি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সচল হয়েছে। অনেক শিল্প কারখানা তার থেকেও বেশি। তবে সেবাখাতগুলোতে অনেকটা কম। সব মিলিয়ে অনেক ভালো যাচ্ছে তা বলা যাচ্ছে না, তবে থাকার চেষ্টা করছি।’
শিক্ষা এবং চিকিৎসা এই দুই সেক্টরে আমরা অনেক বেশি প্রাইভেটের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বহু আগে আমাদের দাতাগোষ্ঠী বুঝিয়েছে সব প্রাইভেট করে ফেলতে হবে। এরপর থেকে সব সরকারি সব বিক্রি করে প্রাইভেট করে ফেলি কিন্তু আজকে এসে দেখা যাচ্ছে সেই প্রাইভেট করোনায় চিকিৎসা দিতেও রাজি নয়। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা হলো পুরোপুরি প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। আবার পুরোপুরি সরকারের ওপরও না। এখানে একটা ভারসাম্য দরকার।’
চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সামাজ-সংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে এত ভঙ্গুর, অগোছালো, ঠুনকো অবস্থায় রয়েছে তা খুব ভালো করে অনুধাবন করা গেছে এই করোনার সময়ে। সব দিক থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি, এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শুধু বাজেটের পরিমাণ অপ্রতুল না, এটির ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে যদি আমরা কোনো শিক্ষালাভ না করে স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি আরও মনোযোগ দিতে পারি তাহলে এটাই আমাদের জন্য বড় শিক্ষা। স্বাস্থ্য খাতে পাবলিক সেক্টরে গুরুত্ব কমিয়ে তুলনামূলক প্রাইভেট সেক্টরকে বাড়ানো হয়েছে। তাদের নানান সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিপদের সময় এই প্রাইভেট সেক্টর থেকে যে ধারণা পেলাম। সেখানে যে অনৈতিক বিষয়গুলা পেলাম। সেখানে সরকারি যে ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকার দরকার সেখানে কিন্তু তা নেই।’
তিনি বলেন, ‘কোভিডের শুরুতে পুলিশ, চিকিৎসক, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ সকলে মিলেমিশে যেভাবে কাজের একটা উদ্যম ছিল তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেটা নাই। একটা স্বাধীন স্বাস্থ্য কমিশন হওয়া দরকার সেটিও হয়নি। এ বিষয়ে সমন্বিত একটা প্রচেষ্টা দরকার।’
ডা. লিয়াকত আলী নাঈমুল ইসলাম খান সাব্বির আহমেদ সারাবাংলা ফোকাস সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান