কোণঠাসা বিএনপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দলীয় কোন্দল
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:২৫
ঢাকা: রাজনীতিতে প্রায় দেড় যুগ ধরে কোণঠাসা হয়ে আছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। টানা ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে রয়েছে দলটি। তার পরও পদ-পদবির ভাগা-ভাগি, ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে দলীয় কোন্দল। মূল দল থেকে শুরু করে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রতিটি স্তরে রয়েছে গ্রুপিং। বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীরা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন। স্বার্থে টান লাগলেই একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হচ্ছেন তারা। শুধু তৃণমূল বা মাঠ পর্যায়ে নয়, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও এ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। পুরো বিষয়টি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বিএনপির অভ্যন্তরীণ এসব কোন্দল সচারাচার বাইরে না এলেও কমিটি পুনর্গঠন, জাতীয়-স্থানীয়-উপনির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় তা দৃশ্যমান হয়। আর শীর্ষ পর্যায়ের দ্বন্দ্বগুলোর বহিঃপ্রকাশ ঘটে দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে শীর্ষ নেতাদের বাক-বিতণ্ডার মধ্য দিয়ে।
সম্প্রতি ঢাকা-১৮ আসনের আসন্ন উপনির্বাচনে ধানের শীষের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দুই আগ্রহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মহানগর (উত্তর) যুবদলের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন ও ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপির যুগ্ম-সম্পাদক এম কফিল উদ্দীন আহমেদের সমর্থকদের মধ্যে সংগঠিত এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা মহানগরে বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মিডিয়ার সামনে দলের শীর্ষ নেতারা বিষয়টিকে হালকাভাবে নিলেও হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ এসেছে ঘটনা তদন্ত করে দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এম কফিল উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দলের স্থায়ী কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আমি অপেক্ষা করব, দেখব তারা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার পর সংবাদ সম্মেলন করে এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনের সমস্ত অপকর্ম মিডিয়ার সামনে তুলে ধরব।’
এদিকে গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপির আটজন কাউন্সিলর প্রার্থী এক যৌথ চিঠিতে দলের হাইকমান্ডকে অনুরোধ করেন এস এম জাহাঙ্গীরকে যেন ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া না হয়। ওই কাউন্সিলররা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ তোলেন।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা মূলত দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ। শুধু ঢাকা-১৮ নয়, গোটা মহানগরেই বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে। কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে চায় না। সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। নয়াপল্ট ও গুলশান কার্যালয়ে মাঝে মধ্যেই এসব ঘটনা দৃশ্যমান হয়।
গত বছর ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাবার্ষিকী উপলক্ষে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা জানানোর সময় ঢাকা উত্তর বিএনপির দুই গ্রুপের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ঢাকা উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুল বাছিদ আঞ্জুকে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীরা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। তার পাঞ্জাবি পুরোপুরি ছিঁড়ে ফেলেন তারা।
গত বছর জুনে নয়াপল্টন কার্যালয়ের নিচে ছাত্রদলের বিদ্রোহী নেতাদের হাতে লাঞ্ছিত হন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ছাত্রদলের ১২ জন নেতাকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এর জের ধরে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কয়েকদফা তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। ঘটে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও।
গত বছর ১৭ নভেম্বর নয়াপল্টনে মহিলাদলের সভাপতি আফরোজা আব্বাসের অনুসারীদের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমদের অনুসারীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফলে ওইদিন দলীয় কার্যালয়ে প্রথমে দুইজনের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা এবং পরে অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। এক পর্যায়ে আফরোজা আব্বাসের অনুসারীরা সুলতানা আহমেদকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে গেলে সুলতানা আহমেদ দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।
মহাসংকটের মধ্যে থেকেও গত এক বছরে এ ধরনের কয়েক ডজন ঘটনা ঘটিয়েছে বিএনপির নেতাকর্মী সমর্থকেরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলীয় ঐক্য এবং নির্ভেজাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। বরং প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
শুধু ঢাকায় নয়, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়েও অভ্যন্তরীণ কোন্দল লেগেই থাকে। দলটির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিটে একাধিক কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির দায়িত্বশীল নেতারা একে অপরকে সবসময় কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করেন। ফলে কেন্দ্রের মতো তৃণমূলেও মাঝে-মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং সেই ঘটনার সূত্র ধরে কেন্দ্রের সঙ্গে ‘ভালো’ সম্পর্কের জোরে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে বহিষ্কার পর্যন্ত করিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এসব ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে সবাই যখন একখানে হয়, তখন এ ধরনের ঘটনার অবতারণা হয়। তবে এগুলো কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।’
‘এগুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখি। এগুলো আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব। দলের বৃহৎ ঐক্যের ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলো তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না’— বলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।