রাত পোহালেই মহালয়া, শরতে নয় এবার পূজা হেমন্তে
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:৪৮
ঢাকা: রাত পোহালেই শুরু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার পুণ্যলগ্ন মহালয়া। পুরাণমতে এদিনেই আবির্ভাব ঘটে দেবী দুর্গার। শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই পরিচিত মহালয়া হিসেবে। এ বছর নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিকালেই শুরু হতে যাচ্ছে দেবীপক্ষের সূচনা। আর তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই হবে মাতৃ বন্দনা। দেবী দুর্গার আগমন ধ্বনি শুনতে পাওয়া মহালয়ার দিনটি ঘিরে ব্যস্ত সব পূজা মণ্ডপের সঙ্গে জড়িত আয়োজকরা। ভোরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে বিশেষ আয়োজন।
মহালয়ার দিনে দেবীর চক্ষুদান করা হয়। প্রতি বছর মহালয়ার সাত দিন পর দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটলেও এবার এর ব্যতিক্রম ঘটতে যাচ্ছে। ভক্তদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ করে এ বছর মহালয়ার এক মাস পাঁচ দিন পর আগামী ২২ অক্টোবর থেকে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব শুরু হবে। মূলত এবার ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে দুর্গোৎসব শুরুর মাস আশ্বিন এ বছর মল (মলিন) মাস তথা অশুভ মাস হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় দূর্গাপুজা শুরু হবে মহালয়ার প্রায় একমাস পর কার্তিক মাসে যা তিথি ও ক্ষণ অনুযায়ী ২২ অক্টোবর।
তবে এই প্রথম নয়, এর আগে ১৯৮২ ও ২০০১ সালে একই কারণে মহালয়া ও দুর্গাপুজো শুরুর ব্যবধান প্রায় একমাস হয়েছিল। এরপর আবার ২০৩৯ সালে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে।
মহালয়া থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী দুর্গার আগমন ধ্বনি শুনতে পান। সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন (আগমন) দোলায় (পালকি) চড়ে। যার ফল হচ্ছে মড়ক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। দেবী দুর্গা এবার স্বর্গলোকে বিদায় (গমন) নেবেন গজে (হাতি) চড়ে। যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
পঞ্জিকামতে এ বছরের দুর্গাপূজার সূচি অনুযায়ী ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে দেবীর আগমনধ্বনি অনুরণিত হতে শুরু করবে। ২২ অক্টোবর ষষ্ঠীতে দশভুজা দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্যদিয়ে শুরু হবে পূজার আনুষ্ঠানিকতা। ২৩ অক্টোবর মহাসপ্তমী, ২৪ অক্টোবর মহাষ্টমী ও কুমারী পূজা এবং ২৫ অক্টোবর মহানবমী শেষে ২৬ অক্টোবর বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনের দুর্গোৎসব।
বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্যদিয়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে মহালয়ার অনুষ্ঠান শুরু করা হবে। এই চণ্ডীতেই আছে দেবী দুর্গার সৃষ্টির বর্ণনা ও দেবীর প্রশস্তিগাঁথা। এই দিনেই দেবীর চক্ষুদান করা হয়। পিতৃ-মাতৃহীন সন্তানেরা এই তিথিতে তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে অঞ্জলি দেন তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। সনাতন ধর্মানুসারে এই দিনেই প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠানো হয়। আর প্রয়াতদের আত্মার যে সমাবেশ তাকে বলা হয় মহালয়। মহালয় থেকে মহালয়া, পিতৃপক্ষের শেষ দিন।
বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি। দেশের অন্যান্য মন্দিরেও এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি শ্রী শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তদের নিরাপদে মহালয়া উপভোগ করতে আগামীকাল সকাল ৬ হতে ৭ পর্যন্ত চ্যানেল ২৪ এ সরাসরি সম্পচারিত হবে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির এর মহালয়া অনুষ্ঠান।
এদিকে দেবী দুর্গার আগমনী উপলক্ষে দিনটি উদ্যাপন করতে ভোর সাড়ে পাঁচটায় বনানী মাঠে দেবীবরণের আয়োজন করেছে গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা পরিষদ।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘শারদীয় দুর্গাপূজা’ উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচার হবে মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠান ‘শারদপ্রাতে’। বৃহস্পতিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮ টার সংবাদের পর প্রচার হবে এ অনুষ্ঠান।
এছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ মন্দিরসহ রাজধানীর বিভিন্ন মন্দির ও পূজা মণ্ডপে মহালয়া উপলক্ষে চন্ডীপাঠ, চন্ডীপূজা, আবাহনী সঙ্গীত, ধর্মীয় আলোচনা সভা, ভক্তিমূলক গান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পৃথক বিবৃতিতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দ হিন্দু সম্প্রদায়সহ দেশবাসীকে মহালয়ার শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মলমাস তথা অশুভ মাস কী?
মহালয়াতেই শুরু হয় দেবীপক্ষের। কার্যত মহালয়ার ভোরের আগমনী বার্তা শুনেই বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আমেজ শুরু হয়। সাধারণত মহালয়ার ছয় দিন পরই শুরু হয় দেবীর বোধন। সেইভাবেই বাঙালি পুজোর প্রস্তুতি নেয়। তবে এবার মহালয়ার পর এক মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। তারপর শুরু হবে দুর্গাপূজা।
এর কারণ হিসেবে হিন্দু শাস্ত্রবিদরা জানিয়েছেন, ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে দুর্গোৎসব শুরুর মাস আশ্বিন এ বছর ‘অশুভ মাস’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পঞ্জিকামতে, মহালয়ার এক মাস বাদে দুর্গাপুজোর কারণ হলো দু’টি অমাবস্যাই একইমাসে পড়েছে। আর তার জন্যই এবার পুজো একমাস পিছিয়ে আশ্বিনের জায়গায় কার্তিকে হবে। শাস্ত্রমতে একই মাসে দু’টো অমাবস্যা থাকলে তাকে মলো মাস বলে। মল মাসে কোনো পুজো হয় না। শুধু পুজোই নয় কোনও শুভ অনুষ্ঠানও মল মাসে করা যায় না। পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার পরই দুর্গাপুজো শুরু হত, কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না কারণ পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার পরই আশ্বিন মাসের অধিকমাস বা মলমাস শুরু হচ্ছে।
তাই এ বছর মা দুর্গা আসছেন কার্তিক মাসে। পুরোহিতরা বলছেন, দু’টি অমাবস্যা থাকায় ১৪২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস মল মাস। তাই পুজো এবার শরতে নয়, হেমন্তে। ‘শারদীয়া’ উৎসব হলেও তা হবে ‘হৈমন্তিক’।
সূর্য ও চন্দ্র মাসের গণনার ওপর ভিত্তি করে হিন্দু ক্যালেন্ডার চলে। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী একটি সূর্যবর্ষ ৩৬৫ দিন ও প্রায় ৬ ঘণ্টার হয়ে থাকে। আবার চন্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনের হয়। এই দুইয়ের মধ্যে ১১ দিনের পার্থক্য। টানা তিন বছরে এটি এক মাসের সমান হয়ে যায়। এই অতিরিক্ত মাসের পার্থক্য দূর করার জন্যই প্রতি তিন বছরে একবার অতিরিক্ত মাস আসে। একেই অধিকমাস বলা হয়। এ বছর আশ্বিন মাসই সেই অধিকমাস। অধিকমাসকে মলমাস বলা হয় কারণ গোটা মাসে কোনও সূর্য সংক্রান্তি থাকে না। আবার প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, একই মাসে দুটি অমাবস্যাকেও মলমাসের অন্যতম কারণ মনে করা হয়। তাই মহালয়ার দিন নিয়ম মেনেই পিতৃ তর্পণ হবে।
উল্লেখ্য, বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবী দুর্গা অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক রূপে পূজিত দেবী। তিনি মহামায়া যিনি অসীম শক্তির উৎস। হিন্দু পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। সেই মহিষাসুর বধের যাকে শিবের বর অনুযায়ী কোনো মানুষ বা দেবতা হত্যা করতে পারবে না। বর পেয়ে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। একসময় মহিষাসুর অধীশ্বর হতে চায় সমগ্র বিশ্বের। আর সেই সময়েই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের সম্মিলিত শক্তিতে মহামায়ার রূপে অমোঘ নারীশক্তির সৃষ্টি হয়। দেবী সজ্জিত হয় দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে সিংহবাহিনী নিয়ে। আর তা নিয়ে নয়দিন ব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করে মর্ত্যে শান্তি স্থাপনা করেন দেবী দুর্গা।