Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুরনো লাইন আর অবৈধ গ্যাস সংযোগে বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে রাজধানী


১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:২১

ঢাকা: অর্ধশত বর্ষের ঝরাজীর্ণ পুরোনো লাইন আর অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতিনিয়ত গ্যাস লাইনে লিকেজ সৃষ্টি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। এতে কখনও কখনও কর্তৃপক্ষ লিকেজের খবর পেয়ে মেরামত করে। তবে অধিকাংশ সময়ই এসব লিকেজের খবর পেয়েও কর্তৃপক্ষের ভূমিকা থাকে নীরব। ফলে মেলে না আর স্থায়ী সমাধান। এতে রাজধানীজুড়ে ক্রমেই বাড়ছে গ্যাস বিস্ফোরণে মৃত্যুফাঁদের ঝুঁকি।

তবে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, পুরোনো লাইন আর অবৈধ সংযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা সংস্থার উন্নয়ণ কাজে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও গ্যাস লাইনে লিকেজ হচ্ছে। খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক মেরামতও করা হচ্ছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। যদিও নগরবাসী বলছে, গ্যাস লাইসে লিকেজের খবর দিলেও সঠিক সময়ে আসে না গ্যাস কর্তৃপক্ষের মেরামতকারীরা। এতে ঝুঁকি আরও বাড়ে। কখনও কখনও বিস্ফোরণও ঘটে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনাও তার একটি।

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, সম্প্রতি রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকায় ১০ লাখ রাইজারের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার রাইজারে লিকেজ পাওয়া গেছে। যদিও এসব লিকেজের মেরামতের কাজ চলছে। কিন্তু অবৈধ সংযোগ এবং মরচে ধরা পুরোনো লাইন তো এ হিসাবের বাহিরে। সেগুলোর ঝুঁকি নিরূপণ করা কঠিন। তবুও স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে সেগুলোর অনুসন্ধানে তৎপর হয়েছে তিতাস কর্তৃপক্ষ।

তিনি বলেন, রাইজারে নানা কারণে লিকেজ হতে পারে। কিন্তু সেটি আবার সহজে মেরামতও করা যায়। কিন্তু লাইন লিকেজ আর অবৈধ সংযোগগুলোর লিকেজ সম্পর্কে জানতে পারা দুষ্কর। যদিও গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর রয়েছে। তবুও অনেক সময় এসব ত্রুটি ধরা পরে একেবারে ব্লাস্ট হওয়ার পর।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর জুরাইনে আলম মার্কেটের সামনের সড়কের পাশে গত বেশ কয়েকদিন ধরে জমে থাকা পানি বুদ বুদ করে উৎরাচ্ছে। এতে স্থানীয়রা দেখতে পান গ্যাসের গন্ধ রয়েছে। যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গ্যাস লাইন লিকেজ হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়রা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করলেও এখনও মেরামত সম্পন্ন হয়নি।

ওই মার্কেটের জুতার দোকানদার রাসেল মুস্তাকিম নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত পরশু তিতাসের লোকজন এসে দেখে গেছে। তারা বলছে রাস্তা কাটতে হবে। তখন চলে গেছে। কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি।’

একই অবস্থা হাজারীবাগের মিষ্টির মোড় সড়কেও। সড়কটির বিভিন্ন স্থানে গ্যাস লিকেজ রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। সেখানকার একজন পান বিক্রেতা আব্দুর রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুতিন মাস আগে এখানে রাস্তার কংক্রিট ফেটে উড়ে গেছে। পরে গ্যাসের লোকজন এসে ঠিক করে গেছে। কিন্তু এখনও বৃষ্টি হলেও পানি জমলে বুদ বুদ করে ফোটে।’

মিষ্টির মোড়ের আরেকটু সামনে এগুলেই আরেকটি মোড় পড়ে ৪১/৬ নম্বা দোকানের সামনের মোড়ে রাস্তার ঠিক মাঝখানে কংক্রিট ধেবে গেছে। যদিও সেখানে কোনো সুয়ারেজের মুখ নেই। সেখানে বৃষ্টির পানে জমে থাকায় ফুটন্ত জলের মত পানি ফুটতে দেখা যায়।

স্থানীয় ফল ব্যবসায়ী রিয়াজ উদ্দিন সারাবাংলাক বলেন, অনেকদিন ধরে এটা দেখতেছি আমরা। প্রায় ১ মাস ধরে। তবে গ্যাস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানেন কিনা সে বিষয় তিনি কিছু বলতে পারেননি।

স্থানীয় আরও কয়েকজন দোকানদারের সঙ্গে কথা বললেও তারা জানান, রাস্তার ওপর হওয়ায় কেউ গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাননি হয়তো।

একই অবস্থা কলাবাগান এলাকার আবেদ ঢালি রোডের ঢালি বাড়ির সামনেও। সেখানেও বেশ কিছুদিন ধরে স্থানীয়রা গ্যাস লিকেজের বিষয়টি টের পেয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখনও লিকেজ মেরামতে কোনো কার্যকরী সমাধান করেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা ও গণমাধ্যমকর্মী সাদ্দিফ অভি সারাবাংলাকে বলেন, ঢালি বাড়ির পাশে একটি নির্মানাধীন ভবন রয়েছে। ভবনের সামনেই গ্যাস লিকেজ দেখা গেছে।এতদিন কনস্ট্রাকশনের আবর্জনা থাকায় কারো চোখে পড়েনি। সেই জায়গা পরিষ্কার করার পর বুদবুদ আকারে গ্যাস বের হওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। লিকেজ দেখার পর স্থানীয়রা বস্তা দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। আমরা গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি।

তিনি বলেন, ‘এখানে ছোট ছোট শিশুরা সারাদিন খেলাধুলা করে। লিকেজের পাশেই বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার রয়েছে। গ্যাস লিকেজের কারণে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে কিনা সেই শঙ্কা আমাদের। তার আগেই বিষয়টি সমাধান করা উচিত।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যখনি খবর পাই কোথাও গ্যাস লিকেজ হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মীরা ব্যবস্থা নিতে কাজ করেন। এতে কোনো অবহেলা বরদাস্ত করা হয় না।’

তিনি বলেন, ‘কলাবাগান এবং হাজারীবাগের বিষয়ে মাত্র শুনলাম। অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জোনাল অফিসে বিষয়টি জানিয়ে দেয়া হবে। শীঘ্রই ব্যবস্থা নেবে। তবে জুরাইনের আলম মার্কেটের সামনে লিকেজের বিষয়ে খবর পাওয়ার সঙ্গে আমি নিজেই সংশ্লিষ্টদেরকে পাঠিয়েছি। তারা সেটি সমাধান করছেন। সেখানে পুর্ব জুরাইনেও একটা মসজিদের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন গিয়েছে। ওই লাইনের শেষ মাথা রাস্তায় পড়েছিল। কিন্তু রাস্তার প্রায় সাত আট ফুট নিচে গ্যাস লাইনটি লিকেজ পেয়েছি আমরা। প্রায় তিনদিন লেগেছে সেটির সমাধান করতে।’

আলী আল মামুন বলেন, ‘অনেক মনে করে আমরা অবহেলা করি বা লিকেজের খবর পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নিচ্ছি না। আসলে এটি ভুল ধারণা। বরং আমরা লিকেজ অনুসন্ধানে অফিসিয়ালি লিকেজ ডিটেক্টরের মাধ্যমে যেমন খবর রাখি তেমনি এক ধরনের গন্ধ যুক্ত পাইপ স্থাপনের মাধ্যমেও স্থানীয়দের মাধ্যমে সব সময় খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি কোথাও লিকেজ রয়েছে কিনা। কিন্তু সমস্যা হলো অবৈধ সংযোগ। এসব সংযোগ তারা বিশেষ করে আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলা নিতে গিয়ে লাইনে নিরাপত্তাজনিত কোনো নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে না। যেটা আমরা সংযোগ দেয়ার সময় প্রতিটি ধাপে নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সেটি পরীক্ষা করেই সংযোগ স্থাপন করি। কিন্তু অবৈধ সংযোগ স্থাপনকারীরা নিরাপত্তা তো দূরের কথা গন্ধযুক্ত পাইপও বসায় না।’

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, ‘নেদারল্যান্ড সরকারের যৌথ উদ্যোগে গত দু বছর ধরে লিকেজ ও গ্যাস লাইনের ত্রুটি খুঁজে বের করতে কাজ করা হয়েছে। এতে রাজধানীতে প্রায় ৩৬ হাজার লিকেজ পাওয়া গেছে রাইজারে। এসব লিকেজ মূলত নানা কারণে হয়। বিশেষ করে মরিচা পড়া এবং দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের চাপে ক্ষয় হওয়াসহ নানা কারণ রয়েছে। কিন্তু এগুলো তাৎক্ষণিক মেরামত করা যায়। তবে বর্তমানে গত কয়েক বছর ধরে পাইপ লাইনে লিকেজ সৃষ্টির হওয়ার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হল অন্যান্য সংস্থাগুলো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির সময় আমাদেরকে না জানিয়ে নিজেদের কাজ করে। কিন্তু তখন লিকেজ হলেও আমরা জানতে পারি না। তারা কাজ করে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরে দেখা যায় সেখানে লিকেজ ধরা পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকায় তিতাস গ্যাসের ৪০-৫০ বছরের পুরোনো যেসব গ্যাস লাইন রয়েছে সেগুলো অপসারণ করে নতুন স্থাপনের জন্য ১২’শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পটি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে পুরান ঢাকার পাইন লাইনগুলো অপসারণ করা হবে। এতে করে লিকেজের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করি আমরা।’

গ্যাস লাইন গ্যাস লাইনের ত্রুটি গ্যাস সংযোগ পুরনো সংযোগ বিস্ফোরণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর