করোনায় বিদেশি বিনিয়োগ তলানিতে
২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৪১
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে চলতি বছরে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) তলানিতে ঠেকেছে। চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হলেও জানুয়ারি থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা দেখা দেয়। ২০২০ সালের প্রথম তিন মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে কিছু বিনিয়োগ এলেও পরের দুই মাস এপ্রিল ও মে বিনিয়োগ শূন্য থাকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য বলছে, জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে কিছু বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়ে নিবন্ধন করেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কোনো অর্থ বিনিয়োগ করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নেমে আসে মাত্র ৫৮ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলারে। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের একই সময়ে দেশে এফডিআই এসেছিল ১০৩ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। অর্থাৎ ওই বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এ বছরের প্রথম তিন মাসে বিনিয়োগ কমে ৪৫ কোটি ৩৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে সবচেয়ে বেশি এফডিআই এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। এরপর রয়েছে নরওয়ে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড। এসব দেশে টেলিযোগাযোগ, নির্মাণ, বিদ্যুৎ, বস্ত্র ও পোশাক, বাণিজ্য, খাদ্য, ব্যাংকিং, গ্যাস, তথ্যপ্রযুক্তি, চামড়া, কেমিক্যাল, বিমা, সিমেন্ট ও সার খাতে বিনিয়োগ করেছে।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে লকডাউন থাকায় গত এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশে বিদেশ বিনিয়োগ ছিল একেবারে শূন্য। তবে জুন মাস চারটি, জুলাই মাসে ১০টি ও আগস্ট মাসে পাঁচটি বিদেশি প্রকল্প নিবন্ধন করেছে। সবশেষ তিন মাসে এই ১৯টি বিদেশি প্রকল্প বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে নিবন্ধন করলেও কোনো বিনিয়োগ এখনো করেনি।
এদিকে, চলতি বছরে এপ্রিল থেকে জুন— এই তিন মাসে বিডার নিবন্ধন পরিসংখ্যান বলছে, আগের বছরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে বিনিয়োগ নিবন্ধন কমেছে ৫৫ শতাংশ। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন তিন মাসে নিবন্ধিত বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ৩ কোটি ৪২ লাখ ডলারের। চলতি ২০২০ সালের একই সময়ে বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধন হয় ১ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের। তবে এপ্রিল ও মে মাসে কোনো বিনিয়োগ নিবন্ধন করেনি, যা হয়েছে শুধু জুন মাসে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সারাবিশ্ব এখনো করোনা মহামারি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আমরা বিশ্ব মহামারির মধ্যে রয়েছি। জীবন বাঁচানোর জন্য এপ্রিল ও মে— এই দুই মাস পুরোপুরি লকডাউন ছিল। পরে অফিস-আদালত চালু হলেও পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক না।
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ মানে হলো বিদেশিদের বিনিয়োগ। বিদেশিরা যেখান থেকে আসবে, সেখানেও করোনা আছে। স্বাভাবিকভাবে তারা ওখান থেকে বের হচ্ছে না। আবার বাংলাদেশে যখন করোনা আছে, তখন তারা বাংলাদেশেও আসবে না। এটাই স্বাভাবিক। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ কম হচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, এপ্রিল ও মে মাসে সবকিছু বন্ধ থাকায় ওই সময়ে বিনিয়োগ ছিল শূন্য। এই সময়ে কোনো প্রকল্পই নিবন্ধন হয়নি। তবে জুন, জুলাই ও আগস্টে ১৯টি প্রকল্প নিবন্ধন করেছে। আবার বিদেশি প্রকল্প নিবন্ধন করা মানেই বিনিয়োগ না। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করেছে, সেগুলো যদি আসত তাহলে বাংলাদেশে বিনিয়োগে ভরে যেত। কিন্তু বাস্তবে তার এক-তৃতীয়াংশও আসে না।
বিডার চেয়ারম্যান বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য প্রমোশনাল কিছু কাজ করতে হয়। আমরা সেগুলো করছি। কিন্তু করোনার সময়ে প্রমোশনাল কাজটিও সেভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও আমরা জাপান, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, করোনা পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগে অনেক ভালো কিছু দেখার সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ করে করোনার কারণে অনেক কোম্পানি চীন থেকে মাইগ্রেট করছে। কিন্তু সেই সুযোগটা আমরা কাজে লাগাতে পারছি না।
তিনি বলেন, করোনার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক কারণেও বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। চীন, জাপান থেকে অনেক কোম্পানি চলে আসছে। আবার ট্যারিফসহ নানামুখী কারণে চীনা কোম্পানিগুলোও রি-লোকেট করছে। ভারত-ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ সরে আসা বিনিয়োগ পেতে শুরু করলেও আমরা এখনো কিছু পাইনি।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এখনো নীতিমালার দিক থেকে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সারাবিশ্বেই বিনিয়োগ মন্দা যাচ্ছে। তারপরও আমরা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে চাই, তাদের কলকারখানা করার জন্য জমি দিতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে গুড গভর্ন্যান্স ও গুড পলিসি দরকার। কিন্তু এই দুইটি ক্ষেত্রেই অমাদের ঘাটতি রয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার বা ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এর পরিমাণ মাত্র ৫৮ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এ বছরেও বিদেশি বিনিয়োগ ২০০ কোটি ডলারের নিচেই থাকতে পারে।