Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পরিবেশ সুরক্ষায় প্রয়োজন সচেতনতা, আইনের বাস্তবায়ন’


২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:২৮

ঢাকা: পরিবেশ সুরক্ষায় ব্যক্তি পর্যায় থেকে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পরিবর্তন ঘটাতে হবে মন ও মানসিকতার। শিশুদের প্রাথমিক স্কুল থেকেই পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষায় আরও বেশি প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে ব্যবস্থা। এছাড়া যেকোনো উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের আয়োজন সারাবাংলা ফোকাস অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানীর সঞ্চালনায় নিয়মিত এই আয়োজনের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘পরিবেশ নিরাপত্তা ও আমরা’।

ভার্চুয়াল এই আলোচনায় যুক্ত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ আতিক রহমান ও ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তরুণ পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ফারিহা সুলতানা অমি। অনুষ্ঠানটি একযোগে সারাবাংলা ডটনেটের ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেল ও বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয়।

অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, পরিবেশ দূষণ যে কেবল মানুষের কারণে, তা নয়। প্রাকৃতিক কিছু বিষয়ও আছে। আমার নির্বাচনি এলাকার পরিবেশ দূষণ কিন্তু ওই অর্থে মানবসৃষ্ট না। যেহেতু সমুদ্রের পানি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে, আগে যেখানে মোটামুটিভাবে একটু ফসল হতো, এখন তাও হচ্ছে না। খাপ খাইয়ে চলতে হবে বলেই আমাদের এলাকার মানুষ এখন লবণাক্ত পানিতে চিংড়ি চাষ করছে। চিংড়ি চাষই এখন তাদের একমাত্র উপার্জন। কেউ হয়তো শ্রম দিয়ে কাজ করে, কারও হয়তো ঘের আছে।

তিনি বলেন, পরিবেশ একেক জায়গায় একেকভাবে দূষিত হয়। উত্তরবঙ্গে পানির স্তর এতই নিচে চলে গেছে যে সেখানে পানির অভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। কোনো জাযগায় আছে আর্সেনিকের দূষণ। আর আমরা এখন যে জায়গায় আছি (ঢাকা), সেখানের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে উন্নয়নের কারণে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ হয়েছে এই রাষ্ট্রের কারণেই। এত বেশি কাজ চলছি ঢাকায় যে সত্যিকার অর্থে অনেক মানুষ অসহায় বোধ করছিল। আমরা ঢাকায় যেসব উন্নয়ন করছি, তার আগে যতটা সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার, তার শর্ত মেনেই কিন্তু তারা কাজ করতে আসেন। কিন্তু বাস্তবায়ন করেন না। একইভাবে আমার এলাকায় সিমেন্ট কারখানা আছে, গার্মেন্টস আছে। তারাও যেটা করা দরকার, সেটা করে না। সত্যিকার অর্থে যদি আমরা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইটিপি ব্যবহার করতাম, তাহলে হয়তো পরিবেশ দূষনের এত সমস্যা থাকত না।

বিজ্ঞাপন

উপমন্ত্রী বলেন, আমাদের অধিদফতর সবাইকে মাঝেমধ্যে জরিমানা করে। তখন ফ্যাক্টরিগুলো বলে আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা ইটিপি তৈরি করে নেব। কিন্তু কেউ করে না। এ কারণে আমাদের অধিদফতরের পক্ষে থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে এমন কিছু উদ্ভাবন করার, যার মাধ্যমে অফিসে বসেই বুঝতে পারব যে কারা ইটিপি বন্ধ করেছে, কারা চালু রেখেছে। কারণ অনেকে ইটিপি বসিয়েও তা বন্ধ করে রাখেন।

সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাবিবুন নাহার বলেন, আইন তো অনেক আছে। আইন থাকা সত্ত্বেও আমাদের জনগণ আইন মানতে ইচ্ছুক না। সে কারণে আমাদের পরিবেশ হয়তো এতটা বিরক্ত। সবাই মিলে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালালে হয়তো এটা এতটা সমস্যা হতে না। আমার কাজের জন্য পরিবেশ দূষণ হতে পারে। সেটা মাথায় রেখে যদি দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করা যায়, তাহলে মনে হয় পরিবেশ দূষণ অনেকটাই কমে যাবে।

জনগণকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন জানিয়ে উপমন্ত্রী বলেন, সব চক্রান্তই ধ্বংস হয় যদি জনগণ সচেতন থাকে। সেই জনগণের সচেতনতা আনার জন্য আমাদের পরিবেশ সৃষ্টি তৈরি করতে হবে। তবে সেটা একদিনে হবে না। বর্তমান সরকার পরিবেশের দিকে অনেক বেশি নজর দিয়েছে। শিশুরা যদি ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে আমার মনে হয় তাদের অন্তর থেকে তারা নিজেদের পরিবর্তন করার একটা প্রচেষ্টা থাকবে। প্রাথমিক স্কুল থেকেই শিশুদের পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা উচিত।

আবু নাসের খান বলেন, পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলে কোনো না কোনোভাবে আমাদের স্বাস্থ্যও সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটলে আজ হোক, কাল হোক, আমাদের স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে এবং আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হব। বাতাস দূষণ হলে আমরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হই। এখন আমরা প্রকৃতি ও প্রাণীর জায়গাগুলো দখল করে ফেলেছি। ১৭ লাখ ভাইরাস প্রকৃতিতে আছে, যেটা মানবশরীরে যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। এর মধ্যে ৭ লাখ ভাইরাস খুবই মারাত্মক বিপদজনক। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরা আমাদের আক্রমণ করতে পারে।

তিনি বলেন, করোনার মতো একটি ভাইরাসের কারণেই বিশ্বের কী অবস্থা, তা তো আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। এমন আরও ভাইরাস আছে যেগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে আমাদের আক্রান্ত করতে পারে। এছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিপর্যয় হয়। কিন্তু আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা কম থাকে। বৈশ্বিকভাবে বিশ্বের পরিবেশের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে তার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব আমরা বাংলাদেশিরা। অভ্যন্তরীণভাবে ইট ভাটা, কাপড়ের শিল্প রয়েছে। এখানে এমন শিল্পগুলোই এসেছে যে শিল্পগুলো বিশ্বের পরিবেশের ক্ষতি করে। আবার এই সব শিল্পগুলোকে আমরা যদি জায়গা না দেই, তাহলে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে না, কর্মসংস্থান হবে না। ফলে উন্নয়নটা এমনভাবে করতে হবে যেন পরিবেশ দূষণ না হয় কিংবা কম হয়। উন্নত দেশগুলো থেকে ভালো কোনো শিল্প আমাদের দেশে আসছে না। গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন কারখানা করার জন্য ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়েছে। কিন্তু এর মূল্য বায়ার বা উন্নত দেশগুলো দিচ্ছে না। বৈশ্বিক অর্থনীতিই আমাদের সবুজ কারখানা দিকে যেতে দিচ্ছে না। কিন্তু তার জন্য আমাদের বসে থাকা যাবে না।

পবা চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমান সরকার পরিবেশ সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর। তারা কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সংরক্ষণে বেশ আগ্রহী। বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণে পরিবেশ আইন বাস্তবায়ন করা কঠিন। আঞ্চলিক পর্যায়েও পরিবেশ রক্ষা আইন সবসময় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাও সচেতন না।

আতিক রহমান বলেন, আমাদের চারপাশের যা কিছু আছে, তার সবকিছু নিয়েই পরিবেশ। কিন্তু দুভার্গ্যজনকভাবে মানুষ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। অথচ মানুষের কাজ পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা না। মানুষের কাজ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে জীবনটাকে গ্রহণ করা। আজ যদি করোনার কারণের কথা বলি, প্রাণীদের মধ্য থেকে একটি ভাইরাস মানুষের মধ্যে চলে এসেছে, যেটি আসার কথা না।

তিনি বলেন, আমাদের যার যার সীমার ভেতরে থেকে উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আরও বেশি শক্তিশালী হতো পারত। কিন্তু সেটি হয়নি। বাংলাদেশে আইনের দিক থেকে আমরা খুবই সমৃদ্ধ, প্রচুর আইন আছে। কিন্তু তার বাস্তাবায়ন নেই বা প্রয়োগের দিক থেকে আমরা দুর্বল। কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশের ক্ষতি হতে পারবে না— এমন নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সমন্বয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে। আমরা এমন কোনো কাজ করব না, যেটা ভবিষ্যতের পরিবেশের চলার পথকে বন্ধ করে দেবে। সুন্দর পরিবেশ, অক্সিজেন পাওয়ার অধিকার সবার রয়েছে। উন্নয়ন করতে গিয়ে আমি প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেব না, পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে থাকব। জনসংখ্যা স্থির রাখতে পারলে পরিবেশ দূষণ ঠিক থাকবে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফারিয়া সুলতানা অমি বলেন, আমাদের শারীরিক বা মানসিক নিরাপত্তা যতটা প্রয়োজন, পরিবেশের নিরাপত্তা তার চেয়েও অনেক বেশি করে প্রয়োজন। এই যে আমরা ঘুম থেকে উঠছি, নিঃশ্বাস নিচ্ছি বা যে খাবারটা খাচ্ছি, যেখানে আমরা চলাফেরা করছি, সবকিছুই কিন্তু এই পরিবেশ ও জলাবায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত। গত বছরই বেশকিছু ঘটনা ঘটে গেছে, যেগুলো পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল হলো, পাশের দেশ ভারতের দিল্লিতে বায়ু দূষণ এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে অক্সিজেন সবাইকে কিনে ব্যবহার করতে হতো। এই যে আমরা পরিবেশকে দূষণ করছি, এর কারণেই পরিবেশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড একেবারেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে আম্পান গেল। আগামীতে যে এমনটা ঘটবে না, তা কিন্তু আমরা নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি না।

তিনি বলেন, পরিবেশ বা জলাবায়ুর নিরপত্তাকে আমরা নিজেরাই প্রতিদিন ধ্বংস করছি। পরিবেশকে যদি ঠিক রাখতে চাই, নিজেদের অস্তিত্বকে প্রকিউর করতে চাই, আমাদেরকে এখন থেকেই অনেক বেশি করে ভাবা দরকার। পরিবেশ নিরাপত্তায় আমরা এখনো সচেতন নই। পরিবেশ নিরপত্তার আইনটিকে আরও বেশি করে বাস্তবায়ন করা দরকার। সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে এই আইনে মেনে চলার প্রবণতা আরও বেশি করে বাড়ানো দরকার।

পরিবেশ আন্দোলনের এই কর্মী আরও বলেন, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের আইনগুলোর ওপর ফোকাস দিতে হবে। আইনগুলো সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সবখানে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পরিবেশ দূষণ রক্ষায় আরও বেশি প্রচার চালাতে হবে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

আবু নাসের খান উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার পবা চেয়ারম্যান পরিবেশ পরিবেশ উপমন্ত্রী পরিবেশ দূষণ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পরিবেশ সুরক্ষা পরিবেশবিদ আতিক রহমান ফারিহা সুলতানা অমি ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার বাংলাদেশ সারাবাংলা ফোকাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর