এসডিজি অর্জনে বাধা ৪৪ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১২:০৭
ঢাকা: সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জনের সরকারি উদ্যোগে সংযুক্ত ৪৪ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। দারিদ্র্য নিরসনে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট: বাংলাদেশ অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজি-১ এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হলো – সম্পদ সংগ্রহ, বিশেষ করে বৈদেশিক উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করা। এছাড়াও, জাতীয় অর্থায়ন কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সম্পদ বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন এবং জুতসই প্রচেষ্টার পাশাপাশি লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থতা অবলম্বন। পাশাপাশি, মধ্যম আয়ের ফাঁদ বাংলাদেশের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের (এলএমআইসি) মর্যাদা লাভ করে। এখন যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এ মধ্যম আয়ের ফাঁদ অতিক্রম করে উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধি ও এসডিজি-১ বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, জাতীয় উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ও নিম্ন দারিদ্র্য রেখার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার স্থিতিশীলভাবে কমছে।
সাম্প্রতিক প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০১৯ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। পাশাপাশি নিম্ন দারিদ্র্য নেমে এসেছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে। ঘাতসহনশীল, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও ত্বরিত প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলায় সরকার প্রয়োজনীয় নীতি ও কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। কিন্তু, চলমান কোভিড-১৯ মাহামারি দারিদ্র্য নিরসনের গতির ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। সেই সঙ্গে, এসডিজি-১ এর ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
পাশাপাশি, এসব মোকাবেলায় কি করণীয় সেগুলোরও উল্লেখ করা হয়েছে। জিইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য বিশেষ করে চরম দারিদ্র্য অত্যন্ত জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যাগুলোর একটি। এ থেকে উত্তরণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সমন্বয়ে প্রত্যেক দেশের জন্য নির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে, হতদরিদ্র মানুষ সবসময় পিছিয়ে থাকে এবং অনুকূল পরিবেশের অভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনা। চরম দারিদ্র্যের অর্থ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজস্ব কোন পছন্দ বা সুযোগ প্রাপ্তির সক্ষমতা থাকেনা। তারা মৌলিক মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত এবং সমাজের কর্মকান্ডে কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারেনা।
হতদরিদ্র মানুষ যেসব সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করে, তারমধ্যে রয়েছে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া, পর্যাপ্ত খাদ্য ও পোষাকের অভাব, জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজের অভাব অথবা খাদ্য উৎপাদনে জমির সংকট এবং ঋণ প্রাপ্তিতে অক্ষমতা। এসবের অর্থ হলো ক্ষমতাহীনতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং পরিবার ও সমাজ থেকে বিযুক্তি। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে প্রান্তিক পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হন এবং সুপেয় পানি ও পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
দারিদ্র্য নিরসনে অন্যান্য চ্যালেঞ্জ
এসডিজি-১ এর প্রয়োজনীয় অর্থায়ন আরেকটি চ্যালেঞ্জ। চরম দারিদ্র্য নিরসন ২০১৭ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৪ বছর ধরে প্রতিবছর এ খাতে অতিরিক্ত তিন হাজার ৯৪০ কোটি (৩৯.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকা ব্যয় করার প্রয়োজন পড়বে।
এছাড়া এসডিজি-১ এর অগ্রগতি পরিমাপ করতে প্রয়োজনীয় গুণগত মানসম্পন্ন উপাত্ত প্রস্তুত করা ও অন্য সংস্থার উপাত্ত ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে জাতীয় পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পেশাগত সক্ষমতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের বহু পরিবার দারিদ্র্য রেখার কাছাকাছি অবস্থান করছে এবং যেকোনো ধরনের অভিঘাত এসব পরিবারকে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিতে পারে। যা দারিদ্র্য দূরীকরণের সফলতাকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। বাংলাদেশে প্রায়ই বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। এসব দুর্যোগ এসডিজি-১ বাস্তবায়নে বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার জন্য এ চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলা এ অভিষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভবিষ্যৎ করণীয়
জিইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের জন্য উপযুক্ত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি সব পর্যায়ের দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতায় আনতে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া সকল নারী-পুরুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি, মৌলিক সেবায় অভিগম্যতা, সম্পদের মালিকানা ও ভূ-সম্পত্তিসহ অন্যান্য সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রাকৃতিক সম্পদ ও উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ এবং আর্থিক সেবা প্রাপ্তিতে নারী-পুরুষের সমতা বিধান করতে হবে। দরিদ্র ও যারা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার তাদের অভিঘাত মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
একই সঙ্গে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট অভিঘাত সহ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত অভিঘাত ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য ও ঝুঁকিপূর্ণতা থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন উৎস থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সম্পদের সংগ্রহ বাড়াতে হবে। সকল মাত্রার দারিদ্র্য বিলোপে প্রয়োজনীয় কর্মসূচি ও নীতির বাস্তবায়ন পর্যাপ্ত ও সম্ভাব্য উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি পরিচালনায় প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও জেন্ডার সংবেদনশীল উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে বিচক্ষণ নীতি কাঠামো প্রণয়ণ করা প্রয়োজন। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি সাধনে গুরুত্বারোপ করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিকতর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও সংস্কার দরকার।
এছাড়া, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কর্মে নিয়োগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো এবং বাজারমূখী কর্মের জন্য গুণগত প্রশিক্ষণ জোরদার করা উচিত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না – প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ক্ষমতায়ন দরকার। এ ক্ষমতায়নের জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং দলিত ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিতে তাদের জন্য কোটাসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা এবং উপযুক্ত চাকরী সৃষ্টি করতে হবে। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরির বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। চরম দারিদ্র্যের বিলোপ সাধন এবং অসমতা ও ঝুঁকি কমাতে সরকারের গৃহীত ব্যাপক সামাজিক সুরক্ষা কৌশল সময়মতো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
চরম দারিদ্র্য দারিদ্য নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ পরিকল্পনা কমিশন মধ্যম আয়ের দেশ সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)