প্রবাসী স্বামীর উৎসাহ, ইউটিউব ভরসা— মাল্টা চাষে বাজিমাত আফরোজার
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:২৯
নড়াইল: স্বামী লাবলু সিকদার সৌদি আরব প্রবাসী। ঘরের কাজ ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না স্ত্রী আফরোজা আক্তারের। কর্মহীন থাকতেও ভালো লাগছিল না তার। কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয় স্বামী লাবলুর সঙ্গে। তিনিই আফরোজাকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেন মাল্টা চাষে। দেশে তেমন একটা প্রচলিত না হলেও স্বামীর উৎসাহে খোঁজখবর নিতে থাকেন। সেইসঙ্গে ইউটিউবে নিতে থাকেন মাল্টা চাষের প্রাথমিক পাঠ।
এরপর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন মাল্টা চাষে বাজিমাতই করে ফেলেছেন আফরোজা। পাঁচ একর জমির তিন বাগানজুড়ে এখন গাছে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে রয়েছে মাল্টা। মাস দুয়েকের মধ্যেই বাজারজাত করা যাবে বলে জানালেন আফরোজা। ধারণা করছেন, প্রথম মৌসুমেই চার লাখ টাকারও বেশি অঙ্কের মাল্টা তিনি বিক্রি করতে পারবেন। এখন পর্যন্ত এই চাষবাসে যেভাবে এগিয়েছেন, তাতে সেই লক্ষ্যটা পূরণও কেবল সময়েরই ব্যাপার বলেই মনে করছেন তিনি।
আফরোজা আক্তারের স্বামী লাবলু সিকদারের গ্রামের বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার মাউলী ইউনিয়নের কাঠাদুরা গ্রামে। স্বামী সৌদি প্রবাসী। তার রেমিট্যান্সের টাকায় এমনিতে দিন ভালোই কাটছিল আফরোজার। কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার তাড়না ছিল। স্বামী লাবলুও তাকে দমিয়ে রাখতে চাননি। বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে পাশের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া ইউনিয়নের লুটিয়া গ্রামে ছিল পাঁচ একর জমি। বলেন, সেই জমিতেই আফরোজা গড়ে তুলতে পারেন মাল্টার বাগান। শুরুতে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও এগিয়ে যান সে পথেই।
শুরুর সময়টা সম্পর্কে আফরোজা সারাবাংলাকে বলেন, শুরুতে ইন্টারনেটে, বিশেষ করে ইউটিউবে মাল্টা চাষ সম্পর্কে তথ্য নিতে থাকি। মনে হয়, পারব। স্থানীয়ভাবে খোঁজখবর করতে থাকি। এ এলাকায় মাল্টা চাষ সম্পর্কে কারও কাছ থেকে ধারণা পেলাম না। পরে ময়মনসিংহ জেলার একটি নার্সারিতে চারা পাওয়া যায় জানতে পারলাম। যোগাযোগ করলাম সেখানে। সে প্রায় আড়াই বছর আগের কথা।
আফরোজা বলেন, আমাদের এখানে জমি তিনটি। একটির আয়তন তিন একর, বাকি দুইটি এক একর করে। সব মিলিয়ে তিন জমিতে পাঁচ একর। ময়মনসিংহের ওই নার্সারি থেকে এই পাঁচ একর জমির জন্য এক হাজার তিনশ চারা নিয়ে আসি। শ্রমিক দিয়ে চারা লাগাই। এরপর শুরু হয় যত্নের পালা। চারাগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
এর মধ্যে দেড় বছর পেরিয়ে দুই বছরের পথে। চারা গাছগুলো তখন আর চারা নেই। ধীরে ধীরে গাছে আসতে থাকে ফুল। যেসব গাছে প্রথম ফুল এসেছিল, চলতি বছরের শুরুর দিকে সেই গাছগুলোতে ফলের দেখাও মিলতে থাকে। এরপর এখন আফরোজার তিন বাগানের প্রায় এক হাজার গাছে থোকা থোকা কেবল মাল্টা। কোনো গাছে ২০টি, তো কোনো গাছে ৩০টি মাল্টা এসেছে। কোনো কোনো গাছে মাল্টা রয়েছে ৫০টিরও বেশি।
আফরোজা জানান, মাল্টা গাছের ফলন হিসেবে মাল্টার সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে প্রথম বছরই তো সব নয়, পরের বছরগুলোতে ধীরে ধীরে ফলন আরও বাড়বে— তেমনটিই জেনেছেন তিনিও। তারপরও প্রথম মৌসুমের এই মাল্টাগুলো বাজারে উঠলে চার লাখেরও বেশি টাকা পকেটে আসবে— আশা করছেন আফরোজা।
চাষবাসের কৌশল-বিড়ম্বনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মাল্টা গাছে মাঝে মধ্যে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। তবে তার প্রতিকারও আছে। ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের টিউটোরিয়াল আছে। সেগুলো খুব কাজে লাগে। তাছাড়া লোহাগড়া উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকেও পরামর্শ পেয়েছি। তাদের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ ব্যবহার করে ছত্রাক দমন করা সম্ভব হয়েছে।’
আফরোজা বলেন, অন্যান্য ফসল চাষের তুলনায় মাল্টা বাগান থেকে আর্থিক লাভটা বেশি। কারণ সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে পারলে ফলন ভালো হয়। তাতে বিনিয়োগের তুলনায় দীর্ঘ মেয়াদে মাল্টা গাছ থেকে আয়টা অনেক বেশি।
অবশ্য মাল্টার ফলন নিয়ে না হলেও বাজারজাত করা নিয়ে কিছুটা শঙ্কার মধ্যে আছেন আফরোজা। কারণ তার মাল্টা বাগানে যাতায়াতের একমাত্র যে রাস্তা, সেটি কাঁচা। বৃষ্টি-বাদলে তার অবস্থাও শোচনীয়। আপাতত স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তিনি, যেন রাস্তাটি বেহাল দশা থেকে মুক্তি পায়, তাতে উপকৃত হবেন স্থানীয় সবাই।
এদিকে, আফরোজার মাল্টা বাগানের বয়স প্রায় আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও এই প্রথম ফলন এসেছে। বছরের শুরু থেকে ফল দেখা গেলেও এখন সেগুলো টসটসে হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এ খবরও ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের এলাকাগুলোতে। অনেকেই একনজর ছুটে আসছেন মাল্টা বাগান দেখতে। কেউ কেউ মাল্টা চাষে আগ্রহও দেখাচ্ছেন। আফরোজার কাছে জানতেও চাইছেন কী করলে তারাও এমন সফল কৃষি উদ্যোগের পথে হাঁটতে পারবেন।
এদিকে, দর্শনার্থীদের কৌতূহল মেটাতে আফরোজাকে দুয়েকটি মোটামুটি পাক ধরে আসা মাল্টা খাওয়াতেও হচ্ছে। তা খেয়েও মুগ্ধ সবাই। তাদের একজন স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষার্থী লাবণ্য খানম। তার বক্তব্য, সারাজীবন মাল্টা তো দোকান থেকেই কিনে খেয়েছি। মাল্টার বাগানও যে এরকম হয়, তা জানতাম না। জেনে দেখতে এসেছিলাম। মাল্টা খেয়েওছি। দোকানে কিনে খাওয়া মাল্টার চেয়ে এই মাল্টার স্বাদ বেশি, মিষ্টিও বেশি।
দিঘলিয়া এলাকার উজ্জ্বল চৌধুরী আবার মাল্টা চাষে আগ্রহের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘মাল্টা বাগানের কথা শোনার পর থেকেই বাগানটি দেখার শখ ছিল। সেই শখ মিটেছে। সেখানে কাঁচা মাল্টা রস করেও খেয়েছি। স্বাদ খুব ভালো লেগেছে। একজন নারী হয়েও আফরোজা এতটা সাহস করে এমন চমৎকার বাগান গড়ে তুলেছেন, দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমি নিজেও মাল্টার একটি বাগান করার চিন্তাভাবনা করছি। দেখা যাক।’
জানতে চাইলে লোহাগড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেন বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাষি আফরোজা পাঁচ একর জমিতে মাল্টার বাগান গড়ে তুলেছেন। আমরা যথাসম্ভব তার তত্ত্বাবধান ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি। আশা করি এ বছর প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করতে পারবেন তিনি। পুরোপুরি উৎপাদন শুরু হলে নড়াইলের চাহিদা মিটিয়ে যশোর ও গোপালগঞ্জ জেলার চাহিদার কিছুটাও পূরণ করা সম্ভব হবে এই বাগান থেকেই।’ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর নড়াইলের উপপরিচালক দীপক কুমার রায়ও আফরোজার মাল্টা বাগান গড়ে তোলার উদ্যোগকে প্রশংসায় ভাসালেন।
ইউটিউব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নড়াইল প্রবাসী স্বামী মাল্টা চাষ লোহাগাড়া