একাদশ সংসদের প্রতি অধিবেশনে কোরাম সংকট ১৯ মিনিট: টিআইবি
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৫৯
ঢাকা: একাদশ সংসদের প্রথম পাঁচটি অধিবেশনে প্রধান বিরোধী দল কিংবা অন্যান্য বিরোধী দলীয় বা স্বতন্ত্র সদস্যরা সংসদ বর্জন ও ওয়াকআউট করেননি। তবে পাঁচটি অধিবেশনের প্রতি কার্যদিবসে গড়ে কোরাম সংকট ছিল ১৯ মিনিট। একাদশ জাতীয় সংসদের ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি অধিবেশনের প্রকৃত মোট সময়ের ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ সময় কোরাম সংকট ছিল। এই সময়ে মোট কোরাম সংকট ছিল ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট, যার প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ২২ কোটি ৮ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ‘পার্লামেন্টওয়াচ: একাদশ জাতীয় সংসদ – প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৯)’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআিইবি‘র ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোরশেদা আক্তার ও নিহার রঞ্জন রায়। এ সময় টিআইবি‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব এবং সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ও বৈষম্যমূলক অবস্থা তৈরি করা হয়। এতে করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৮৯ শতাংশ আসন) নিয়ে সরকার গঠন করে। দশম সংসদের মতোই এই সংসদেও নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল নিয়মরক্ষার বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
টিআইবি‘র প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত, প্রধান বিরোধী দল সতর্কতার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের ছিল না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রম, বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ করা গেছে। সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল।
টিআইবি প্রতিবেদনে বলছে, সংসদ অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যথাযথ আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, সংসদে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শব্দের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। অধিবেশন চলাকালীন সদস্যদের বিচ্ছিন্নভাবে চলাফেরা, কোনো সদস্যের বক্তব্য চলাকালীন তার নিকটবর্তী আসনের সদস্যদের নিজ আসনে বসে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন এবং সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের অমনোযোগিতা লক্ষ করা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদস্যদের বক্তব্যে অসংসদীয় ভাষা (কটূক্তি) ব্যবহার বন্ধে স্পিকার নীরব ছিলেন। এসব সদস্যদেরকে তাদেরকে সতর্ক করা বা শব্দ এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে তার কার্যকর ভূমিকা পালনে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এছাড়া অধিবেশন চলাকালীন গ্যালারিতে শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর ভূমিকার ঘাটতি ছিল। সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সরকারদলীয় সদস্যের পাবলিক পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন এবং একজন অন্যান্য বিরোধী সদস্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিক্রি করলেও তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা পর্বে সদস্যদের বক্তব্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং যুক্তিসঙ্গত বিতর্কের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ সদস্য আলোচ্য বিষয়ের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রখেছেন, কোনো কোনো সদস্য নিজ নির্বাচনি এলাকার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন দাবি উত্থাপনে বরাদ্দ সময়ের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন। সরকারদলীয় সদস্যদের বক্তব্যে নিজ সরকারের আমলের বিভিন্ন কাজের ও পদক্ষেপের প্রশংসা প্রাধান্য পেলেও সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, অনিয়ম-দুর্নীতির মতো বিষয় তুলনামূলকভাবে কম প্রাধান্য পেয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও প্রকল্প সম্পর্কিত প্রশ্ন বেশি উত্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে পদ্মাসেতু ও বরিশাল রেললাইনের অগ্রগতি, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা, ঢাকার যানজট নিরসনে গৃহীত পরিকল্পনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই পর্বে তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের পরিবর্তে সম্পূরক প্রশ্নে সদস্যদের আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদস্যদের একাংশ সম্পূরক প্রশ্ন করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় উত্থাপন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।
সংসদকে কার্যকর করতে টিআইবি‘র প্রতিবেদনে ১২টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে; সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে হবে; সংসদে অধিকতর শৃঙ্খলা রক্ষাসহ অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে বিধি অনুযায়ী রুলিং প্রদান ও অসংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে; এসডিজির বাস্তবায়নসহ আন্তর্জাতিক সব চুক্তি আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন করতে হবে; জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয়— এমন বিষয় ব্যতীত অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির বিস্তারিত সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে; সংসদ সদস্যদের সম্পদের প্রতিবছরের হালনাগাদ তথ্যসহ সংসদের বাইরে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করতে হবে।
টিঅঅইবি‘র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংসদ বর্জন, ঘন ঘন ওয়াটআউট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বন্ধ হয়েছে। আর এটা বন্ধ হলেও জাতিকে অনেক চড়া দাম দিতে হয়েছে। এত বেশি চড়া দাম দিতে হয়েছে যে মাথা ব্যথার জন্য যেন মাথা কেটে ফেলার মতো একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, একাদশ সংসদে কার্যকর অর্থে কোনো বিরোধী দল নেই। বর্তমানে যারা বিরোধী দল আছেন, তারা সরকারের সাথে মহাজোটে থেকে আবার ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বাচন করেছিলেন। সংসদে বিরোধী দলে থাকার জন্য নির্বাচন করেননি। কিন্তু নির্বাচনের পর তাদের অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরোধী দলে বসানো হয়েছে। ফলে সংসদে বিরোধী দলের কোনো জোরালো ভূমিকা নেই। বরং সংসদে সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকটা সর্তকতার সঙ্গে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে।