প্রবীণদের বাসযোগ্য পৃথিবী কতদূর?
১ অক্টোবর ২০২০ ২০:৩৪
ঢাকা: মায়ারানী। বয়স ৮৫ বছর। এই বয়সে পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনী নিয়ে আনন্দঘন দিন কাটানোর কথা ছিল তার। ধনের ঐশ্বর্য না হোক, প্রাণের প্রাচুর্য নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন-অধিকার দু’টিই ছিল তার। কিন্তু সেটি হয়নি! মায়ারানীর শেষ সম্বল পাঁচ শতাংশ জমি নিজের নামে লিখে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন ছেলে দেবকুণ্ডু। নিরুপয় মায়ারানী আশ্রয় নিয়েছেন নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে সংরক্ষিত শিল্পী এস এম সুলতানের নৌকায়!
এ ঘটনাটি গত ২৬ সেপ্টেম্বরের। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (১ অক্টোবর) নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালন করছি, ঠিক তার এক সপ্তাহে আগে ৮৫ বছর বয়সী এক প্রবীণের নিদারুণ জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে এমন খবর ছাপা হয়েছে গণমাধ্যমগুলোতে।
মায়ারানীর ঘটনাটি নিছকই একটি উদাহরণ। আমাদের চার পাশে এমন ঘটনা নিত্যদিনই ঘটে। বয়স্ক নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে গেলে এমন অনেক ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের একটি কক্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক ড. এম আব্দুল আউয়ালের নিদারুণ জীবনযাপন, প্রতিষ্ঠিত তিন সন্তানের জনকের আশ্রয় হলো উত্তরার মসজিদে— এমন অনেক খবর তো মাঝে মধ্যেই আমাদের চোখে পড়ে।
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে— প্রবীণদের জন্য বাসযোগ্য মানবিক পৃথিবী কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি? প্রবীণদের বাসযোগ্য পৃথিবী কতদূর?
প্রথমেই আমাদের জেনে নেওয়া দরকার, প্রবীণ আসলে কারা? কোনো ভূ-খণ্ডের গড় আয়ুর কাছাকাছি কোনো মানবসন্তান পৌঁছে গেলে তিনি প্রবীণ বলে বিবেচিত হন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। সেই হিসেবে বাংলাদেশের ষাটোর্ধ্ব নর-নারীরা প্রবীণ বলে বিবেচিত হবেন। আর জাতিসংঘের মতে, ৬৫ বছর বয়সী নর-নারীরা প্রবীণ হিসেবে বিবেচিত হবেন।
হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনালের এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৯০ কোটি ১০ লাখ প্রবীণ মানুষ আছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে বাড়বে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে— এ বিশালসংখ্যক প্রবীণকে মানবিক জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার মতো রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? বিশ্বব্যাপী ৪৭ শতাংশ প্রবীণ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ প্রবীণ নারী অনানুষ্ঠানিক শ্রমশক্তিতে অবদান রাখছেন। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৬৪ শতাংশ। নারীর ক্ষেত্রে এ সংখ্যা আরও বেশি।
দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ দুঃস্থ ও অসহায় শিশুর যত্ন করছেন দাদা-দাদীরা। বাংলাদেশেও দাদা–দাদী শিশুদের যত্ন নেন। কিন্তু তারা কেউ স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। বরং প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পরিবারের প্রবীণ লোকটিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রবীণদের সেকেলে বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ প্রবীণ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে এ সংখ্যা সীমিত হলেও ২০৫০ সাল নাগাদ এটি অভাবনীয় মাত্রায় পৌঁছবে— সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ৩০ বছর বয়সী যে যুবকটি আজ ইন্টারনেটকে জীবনসঙ্গী বানিয়ে নিয়েছেন, ২০৫০ সালে সেই যুবকটিই হবেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ।
হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনালের এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ৬০টি দেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের সংখ্যা হবে ৩০ শতাংশ। প্রবীণসংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করা মানে নিজের প্রবীণ জীবনকে সুরক্ষিত করা। সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করা।
এমন মোটা দাগের বিশ্লেষণের পর বলতে হয়— আমরা কি পেরেছি প্রবীণবান্ধব একটা সমাজ নির্মাণ করতে? মেগাসিটিতে শিশুপার্ক থাকলেও প্রবীণ পার্ক আছে কি? প্রবীণদের বিনোদনের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা, তাদের হাঁটার জন্য সড়কে আলাদা কোনো লেনের ব্যবস্থা করতে পারছি কি? সর্বোপরি আরবান সিটিতে ফ্ল্যাট বাড়িগুলো তৈরি হচ্ছে, সেখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির পাশাপাশি প্রবীণ মা-বাবা, দাদা-দাদীর জন্য আলাদা ঘর রাখা হচ্ছে কি?
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রবীণদের অধিকার, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিায় কাজ করছে আজহার শফিক ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট এ কে এম শফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘শহরের মোড়ে মোড়ে প্রবীণ নিবাস প্রতিষ্ঠা বা বৃদ্ধাশ্রম বানানো কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। বরং প্রবীণদের পরিবারের সঙ্গে রেখে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। একজন প্রবীণ কেন ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে বসবাস করবেন? ঢাকা শহরে গণপূর্ত বিভাগ যেসব ফ্ল্যাট বানায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য, সেখানে স্বামী-স্ত্রী, কন্যা-পুত্রের জন্য ঘর থাকে। বয়স্ক মা-বাবার জন্য থাকে না। আমরা গণপূর্তের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা যেন ফ্ল্যাট/বাড়িতে বয়স্কদের জন্য আলাদা একটা ঘর বা রুম রাখে।’
মনোবিদ আনোয়ারা সৈয়দ হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বয়স হয়ে গেলেই তিনি অপাঙ্ক্তেয়— এমন ভাবনাটা আগে দূর করতে হবে। কেন বয়স্ক লোক পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রবীণ নিবাসে গিয়ে পড়ে থাকবেন? কেন আমাদের বৃদ্ধাশ্রম বানাতে হবে? সুন্দর বৃদ্ধাশ্রম বানানোর চেয়ে সুন্দর মনের মানুষ তৈরি জরুরি। এমন মানুষ গড়ে তুলতে হবে, যে মানুষগুলো পরিবারের প্রবীণদের নিয়ে মিলে-মিশে থাকার চিন্তা করবে, তাদের আলাদা রাখার চিন্তা করবে না।’
প্রবীণ দিবস প্রবীণদের আবাস প্রবীণবান্ধন পরিবেশ বিশ্ব প্রবীণ দিবস বৃদ্ধাশ্রম