কোন পথে হেফাজত?
৪ অক্টোবর ২০২০ ১০:০১
ঢাকা: ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠনের তকমা লাগিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ। তবে ২০১১ সালে ঘোষিত ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালা’র বিরুদ্ধে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সদ্য প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। আর ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর ‘আস্তিক-নাস্তিক’ ইস্যুতে ‘সহিংস’ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক এই সংগঠনটি।
সে বছর ৪ এপ্রিল ও ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে স্মরণকালের ‘ভয়াবহ’ সহিংস কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের চূড়ান্ত মহড়া প্রদর্শন করে হেফাজতে ইসলাম। রাজনৈতিক ফায়দা লাভের আশায় তাদেরকে প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা দেয় রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। আর নেপথ্য থেকে মূল কলকাঠি নাড়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত।
তবে সরকারের কৌশলী ও কঠোর পদক্ষেপের কারণে ২০১৩ সালের ৫ মে’র পর ধীরে ধীরে শক্তিহীন হয়ে পড়ে হেফাজত। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শফী ও তার অনুসারীরা সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। আর হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও তার অনুসারীরা ‘অনুচ্চস্বরে’ সরকারবিরোধী অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেন।
এরইমধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যু হয়। সেদিন থেকেই সংগঠনটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশজুড়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রশ্ন উঠছে— আহমদ শফীর মৃত্যুতে শূন্য হওয়া হেফাজতে ইসলাম, কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ও হাইআতুল উলয়ার শীর্ষ পদে কারা আসছেন? বিশেষ করে কে হচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের আমির? কার হাতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত, সমালোচিত এই সংগঠনটির নেতৃত্ব?
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জন্ম চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হলেও ঢাকার শাপলা চত্বরে শক্তির মহড়া দিয়ে দেশ-বিদেশে সবার নজরে আসে হেফাজত। কিন্তু এই মুহূর্তে খোদ ঢাকাতেই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে সংগঠনটি। ঢাকা মহানগর হেফাজতের আমির নূর হোসাইন কাসেমী ও মহাসচিব হাসনাত আমীর মধ্যে গত সাত বছরে দেখা-সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা নেই বললেই চলে। যে জামায়াত-বিএনপির অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে ঢাকায় শক্তির মহড়া প্রদর্শন করেছিল হেফাজতে ইসলাম, সেই জামায়াত-বিএনপি জোট থেকে ২০১৬ সালে বেরিয়ে যায় হাসনাত আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট।
সূত্রমতে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ছাড়ার পর হাসনাত আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। সঙ্গত কারণেই এই দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব হাসনাত আমিনীর সঙ্গে বিএনপি জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমির নূর হোসাইন কাসেমীর সম্পর্ক ভালো যাওয়ার কথা না।
শুধু নূর হোসাইন কাসেমী আর হাসনাত আমিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব নয়, হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমীর মুফতি মুহম্মদ ওয়াক্কাছের সঙ্গেও নূর হোসাইন কাসেমীর প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। এই দু’জনের দ্বন্দ্বের জের ধরেই ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ’ ভেঙে দুই টুকরো হয়েছে। একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নূর হোসাইন কাসেমী, আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুফতি মুহম্মদ ওয়াক্কাছ। আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে শফী গ্রুপের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন হেফাজতের নায়েবে আমীর মুফতি ওক্কাছ। আর হেফাজতের মহাসচিব জুনয়াদে বাবুনগরীর প্রতি নিজের সমর্থন অটুট রেখেছেন নূর হোসাই কাসেমী। ফলে হেফাজতের এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালন সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে বাংলাদেশে সব চেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল চরমোনাই পীর সৈয়দ মোহম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন এতদিন হেফাজতে ইসলামকে মৌন সমর্থন দিয়ে এলেও আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তাদের সেই সমর্থন আর থাকবে কি না, তা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রয়াত আহমদ শফীর সম্মানে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই হেফাজতের প্রতি মৌন সমর্থন দিয়েছিল ইসলামী আন্দোলন। কিন্তু আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের অভ্যন্তরে চলমান বিশৃঙ্খলার পর এই সংগঠনটির ওপর আর কোনো সমর্থন বা তাদের কোনো কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশের কোনো সম্ভবনা নেই ইসলামী আন্দোলনের।
বিশ্লেষকের বলছেন, মূলত আল্লামা শফীকে সামনে রেখেই হেফাজতে ইসলাম তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল। কারণ, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ‘বড় হুজুর’খ্যাত আহমদ শফীর ব্যাপক প্রভাব ছিল। তার অনুপস্থিতিতে সম্ভব্য নেতা হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাদের কারও পক্ষে এই প্রভাব বজায় রাখা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন সবাই। বিশেষ করে জামায়াতপন্থী বাবুনগরীর হাতে হেফাজতের নেতৃত্ব গেলে কওমি ধারার আলেমদের মধ্যে বড় একটি অংশের সমর্থন হারাবে হেফাজত।
হেফাজতের নেতাকর্মী-সমর্থকদের একটি বড় অংশের ধারণা, হেফাজতের নেতৃত্ব নিয়ে আমির আহমদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দ্বন্দ্বের জেরেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। আহমদ শফীর মৃত্যুর কারণ হিসেবেও দেখা হচ্ছে এই দ্বন্দ্বকে। তাছাড়া জামায়াত ঘরানার নেতা মাদরাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকে বাদ পড়া বাবুনগরীর আহমদ শফির মৃত্যুর পর পরিচালক পদে নিযুক্ত হয়েছেন। হেফাজতে ইসলামের মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে হয়তো অচিরেই দেখা যাবে তাকে। আর এটি হলে বড় ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব জড়াবে সংগঠনটি।
এছাড়া হেফাজতের আমির হিসেবে সিনিয়র নায়েবে আমির মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নামও শোনা যাচ্ছে। এই মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ও জুনায়েদ বাবুনগরী সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। নাজিরহাট মাদ্রাসায় মুহতামিম নিয়োগ নিয়ে মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধ দেখা দেয় সদ্য প্রয়াত আহমেদ শফী ও তার অনুসারীদের। সুতরাং জুনায়েদ বাবুনগরী বা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী— যিনিই হেফাজতের প্রধান হোন না কেন, তাকে মেনে নেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হবে না।
হেফাজতের আমির পদে ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রধান) নূর হোসাইন কাসেমী ও দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদরাসার মুহতামিম মাহমুদুল হাসানের নামও আলোচনায় আছে। এ দু’জনের মধ্যে নূর হোসাইন কাসেমী আবার বাবুনগরী গ্রুপের সমর্থক। সুতরাং ঘুরে-ফিরে নেতৃত্ব সেই বাবুনগরী অথবা তার অনুসারীদের হাতেই যাচ্ছে। আর এটা হলেই হেফাজতে ইসলামের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাইলে হেফাজতের নায়েবে আমীর মুফতি মুহম্মদ ওয়াক্কাছ সারাবাংলাকে বলেন, ‘হেফাজতের নেতৃত্ব কওমি ধারার আলেমদের হাতেই থাকবে। বাইরের কোনো শক্তির ক্রীড়নক এ সংগঠনে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’