Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএমএ’র ফয়সলের ‘টেন্ডারবাজি’ অনুসন্ধানে দুদক, ২ হাসপাতালে নোটিশ


৪ অক্টোবর ২০২০ ১৯:২২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রথম দফায় দুই সরকারি হাসপাতালে ২০০৮ সাল থেকে টেন্ডারের ভিত্তিতে যত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে, সবগুলোর নথি তলব করেছে দুদক। প্রতিষ্ঠান দুটি হচ্ছে- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতাল।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ ফয়সল ইকবাল চৌধুরীর ‘টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য, ক্লিনিক ব্যবসা, কমিশন ব্যবসাসহ জ্ঞাতআয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ’ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এই নথি তলব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ পুরো স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

সামগ্রিক অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের চট্টগ্রাম জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের-২ উপ-সহকারী পরিচালক মো.শরীফ উদ্দিন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতে যত অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশে আমরা সেগুলোর অনুসন্ধান শুরু করেছি। আমাদের কাছে টেন্ডারবাজির কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা আছে। সেগুলো অনুসন্ধানের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সব নথি তলব করে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য হাসপাতালের বিষয়েও একই প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান শুরু হবে।’

বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবালের অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ১২ দফা অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক নিয়োগ ও বদলি অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ফয়সল ইকবাল বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। শুধু ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চমেক হাসপাতালে প্রায় ৪২ কোটি টাকার টেন্ডার তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিএমএ’র চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক হওয়ায় ফয়সল ইকবাল কাউকে পরোয়া করেন না। তিনি চমেক হাসপাতালের নিয়োগ-বদলি, ঠিকাদারি থেকে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, চমেক হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার খাবার সরবরাহ, আউটসোর্সিং ব্যবসাসহ বিভিন্ন সরবরাহ কাজেরও নিয়ন্ত্রণ করেন ফয়সল ইকবাল। নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্যাডে তিনি প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার বাগিয়ে নেন। জটিল ও কঠিন শর্ত সংযোজন করে আর কোনো ঠিকাদারকে তিনি টেন্ডারে অংশ নিতেও দেনন না। গত ২২ বছর ধরে চমেক হাসপাতালে দৃশ্য-অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। ফয়সলের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে খাবার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করে। আউটসোর্সিংয়ের এক-তৃতীয়াংশ জনবল সরবরাহ করে ওই সিন্ডিকেট।

ফয়সল ইকবাল টেন্ডারের বেশি লাভজনক কাজগুলো জমজম এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে করেন। এর মালিক তার মামা দিদারুল আলম। এই সিন্ডিকেটের অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- আলী অ্যাসোসিয়েট, এম রহমান এন্টারপ্রাইজ এবং সাদমান এন্টারপ্রাইজ। হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. শাহজাহান এবং অফিস সহকারী মঈন উদ্দিন এ সিন্ডিকেটের হয়ে দেখভাল করেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে, ফয়সল ইকবাল ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রামের আলোচিত কোকেন মামলার আসামি নুর মোহাম্মদকে চমেক হাসপাতালে একটি ভিআইপি কেবিনে মাসের পর মাস থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি চমেকর সামনে ইপিক হেলথ কেয়ারের জমি দখল ও ভবন নির্মাণে সহায়তা করে নগদ এক কোটি টাকা ও শেয়ার নেন। তার শ্বশুর প্রতিমাসে তার পক্ষে সেখান থেকে দুই লাখ টাকা করে নেন। চট্টগ্রাম ইপিজেডে ফয়সলের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গ্রিন লাইফ ল্যাব এবং ইপিকে তিনি রোগী পাঠাতে ডাক্তারদের বাধ্য করেন।

এতে আরও বলা হয়ছে, চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদিবাগে তিনি যে ফ্ল্যাটে বসবাস করেন, সেটি দুই কোটি টাকায় কেনা। নগরীর সৈয়দ শাহ রোডে ছয়তলা ভবন নির্মাণ করছেন তিনি। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় নিজ গ্রামে ১০৬ একর পাহাড়ি ভূমিতে গড়ে তুলেছেন আমবাগান ও মাছচাষ প্রকল্প। নগরীর দক্ষিণ খুলশী সিটি করপোরেশন আবাসিক এলাকায় ফয়সলকে সাবেক মেয়র বিনা টেন্ডারে নামমাত্র মূল্যে একটি প্লট বরাদ্দ দেন। এর সঙ্গে লাগোয়া আরেকটি প্লট তিনি বিএনপির তোতনের কাছ থেকে কিনে নেন। এর বাজারমূল্য বর্তমানে চার কোটি টাকা।

সূত্রমতে, অভিযোগটি প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে যাচাইবাছাই করে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২। গত জুনে যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে। এরপর প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বিস্তারিত অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ২৬ আগস্ট অভিযোগগুলো অনুসন্ধানের নির্দেশ আসে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে রোববার (৪ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এবং চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে নথি তলব করে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ২০০৮ সাল থেকে যত টেন্ডার পেয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে যত সরবরাহ ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, তার নথি চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- জমজম এন্টারপ্রাইজ, সাদমান এন্টারপ্রাইজ, আলী অ্যাসোসিয়েট, এম রহমান এন্টারপ্রাইজ এবং শাপলা এন্টারপ্রাইজ। চমেক হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. শাহজাহান এবং মঈন উদ্দিন কীভাবে, কোন যোগ্যতায় টেন্ডারের সঙ্গে সম্পর্কিত- সে বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। মঈন উদ্দিনের বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে বিদেশ ভ্রমণের অভিযোগের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মো. ফোরকানের বিষয়েও একইভাবে তথ্য চাওয়া হয়েছে।

নোটিশে গত ১১ বছরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে দুই হাসপাতালে নিয়োগকৃত জনবলের তালিকা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া চমেক হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ ও স্টোরের সব নথিও তলব করা হয়েছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

ক্ষমতাধর চিকিৎসক নেতা ফয়সল ইকবাল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। গত জুলাইয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনেও ফয়সল ইকবালের নানা অনিয়ম এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে তার নেতিবাচক ও বিতর্কিত ভূমিকার কথা উঠে আসে।

ফয়সল ইকবালের বক্তব্য

টেন্ডারবাজি, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যসহ অভিযোগের অনুসন্ধান এবং দুই হাসপাতাল থেকে দুদকের নথি তলবের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মোহাম্মদ ফয়সল ইকবাল চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি কোনো নোটিশ পাইনি। সুতরাং বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে হাসপাতাল থেকে নথি তলবের বিষয়টি যদি সঠিক হয়ে থাকে, আমি স্বাগত জানাই। আমি চাই সঠিকভাবে তদন্ত করে কার কী ভূমিকা সবকিছু বের করে আনুক। টেন্ডারের জন্য নির্দিষ্ট কমিটি থাকে, মূল্যায়ন হয়। নানা প্রক্রিয়ার পর কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আমি চমেক হাসপাতালের পরিচালকও না, সেখানে চাকরিও করি না, তাহলে আমার সম্পৃক্ততার তো প্রশ্নই আসে না।’

তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আমি চমেকে পিজি কোর্স করি। এরপর আবারও ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকায় একই হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম। ঢাকায় থেকে আমি চট্টগ্রামে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করব? ২০১৬ সালে আমি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে আসি। অভিযোগ যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে করতে পারে। কিন্তু আদৌ এর সত্যতা আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আশা করি, দুদক সঠিকভাবে অনুসন্ধান করে সত্যটা বের করে আনবে।’

জ্ঞাতআয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাকলিয়ায় সৈয়দ শাহ রোডে যে বাড়ির কথা বলা হচ্ছে, সেই জমি ১৯৮৬ সালে আমার বাবা কিনেছেন। তিনি বাড়ি তৈরির কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে আমার বাবা মারা যান। সেই কাজ শেষ করতে গিয়ে আমার প্রায় এক কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে। সেটি আমার পারিবারিক সম্পত্তি, একক নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে যে প্লট পেয়েছি, সেটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়মমাফিক প্রক্রিয়ায় আমি পেয়েছি। আমার গ্রামে ৬ একর পৈতৃক সম্পদের ওপর আমি মাছের চাষ করেছি, ১০৬ একর নয়। সেই প্রজেক্টও আমার বাবাই শুরু করেছিলেন। ইপিকের মালিকানা ও আমার শ্বশুর সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, সেগুলোর কোনো সত্যতা নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে কোনো ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নেই।’

সম্পদ সংক্রান্ত বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ হিসেবে তিনি বেশকিছু দলিলের অনুলিপিও সারাবাংলার কাছে পাঠিয়েছেন।

অনুসন্ধান টেন্ডারবাজি ডা. মোহাম্মদ ফয়সল ইকবাল চৌধুরী দুদক নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য বিএমএ চট্টগ্রাম সাধারণ সম্পাদক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর