‘মহামারিকালে চিকিৎসা বর্জ্যের ৯৩ ভাগই সঠিক ব্যবস্থাপনার বাইরে’
৫ অক্টোবর ২০২০ ১৯:২৩
ঢাকা: বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ৬.৬ ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩.৪ ভাগ বর্জ্যই সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি পরিচালিত ‘কোভিড-১৯ মহামারিকালে কার্যকর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (৫ অক্টোবর) এক ওয়েবিনারের মাধ্যমে ২০ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট ২০২০ সময়কালে পরিচালিত এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদেশে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪৮ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ৩৫ টন (১৪.১%) সঠিক নিয়মে ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। এর অধিকাংশই আবার রাজধানী ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ। তাও আবার মাত্র একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অপসারণ ও শোধন করা হয়। বর্জ্য আলাদা করার ব্যবস্থাপনা থাকলেও, তা বিনষ্ট বা শোধন করার নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাপনা নেই স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর।
ওয়েবিনারের প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, এমপি বলেন, ‘মানুষের ভোগ বাড়তে থাকায় বর্জ্যও বাড়ছে। এ বিষয়ে আমাদের ব্যবস্থাপনার ঘাটতি আছে। এর কারণ আগে থেকে গুরুত্ব না দেওয়া, জন্গণের অসচেতনতা, প্রযুক্তির অভাব আরও অনেক কিছু। এখন যোগ হয়েছে মেডিকেল বর্জ্য। এখন নিয়ম করা হচ্ছে- প্রতিটি হাসপাতালে এই বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলতে হবে। দেশটা তো আমাদের সকলের, তাই সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকেই এই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।’
গবেষণায় আরও উঠে আসে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী থেকে প্রতিদিন ২৮২.৪৫ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার পুরোটাই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে অপসারণ করা হয়। মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন ৭১ ভাগ মানুষ, যার সিংহভাগই শহুরে। যারা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করেন সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে তাদের ১০০ ভাগই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে তা অপসারণ করেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও জানিয়েছেন তারা প্রায় সব বাড়ি থেকেই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যের বর্জ্য পান। যদিও ৮১.৪ ভাগ উত্তরদাতা মনে করেন এসব বর্জ্য থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা আছে এবং ৯০.৬ ভাগ মানুষ মনে করেন এসব বর্জ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘গত মে মাসে শুধু ঢাকাতেই ৩ হাজার টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকার চলতি বছরের ৩০ মে ঘরের বাইরে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। ৮২.১ ভাগ মানুষের কাছে এটি অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ এসব সুরক্ষা সামগ্রী পুনঃব্যবহার করেন।
প্রায় ৫ হাজার মানুষের ওপর পরিচালিত এই জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৮.৫ ভাগ মনে করেন অধিকাংশ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী একবার ব্যবহারযোগ্য। ৮৩.৭ ভাগের মতে, অধিকাংশ মানুষ এসবের সঠিক অপসারণ সম্পর্কে সচেতন নন। ৮৮.৪ ভাগ মানুষ মনে করেন, বাসাবাড়ির বর্জ্যের সাথে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী মেশানো উচিত নয়। এর জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দরকার বলে মনে করেন ৯২.৪ ভাগ মানুষ।
এই জরিপে স্বাস্থ্যখাতে সেবাদানকারী ৩০০ জন ব্যক্তি অংশ নেন, যাদের মধ্যে ‘চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি ২০০৮’ সম্পর্কে জানেন মাত্র ৪৩.৬ ভাগ। ৮৪ ভাগ চিকিৎসাকর্মী মনে করেন, বর্তমান মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক। এই সমস্যা সমাধানে একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা এবং তা বাস্তাবায়ন দরকার বলে মনে করেন ৯০.৩ ভাগ চিকিৎসা কর্মী।
এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ে ২০ জন বিশেষজ্ঞ। তারা মনে করেন, বাসাবাড়ি ও চিকিৎসাকেন্দ্রে কোভিড-১৯ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক জারি করা নির্দেশিকা ও গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি।
সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞ- দুই পক্ষই মনে করেন, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি আধুনিক ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন, অর্থায়ন এবং তা বাস্তবায়ন জরুরি। একই সাথে জনগণকে সচেতন করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এক করে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
ওয়েবিনারের সভাপতি ব্র্যাকের চেয়ারপার্সন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই সমস্যার মোকাবিলায় চারটি বিষয়ে জোর দিতে হবে- সচেতনতাকে অভ্যাসের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, সকলের উদ্যোগের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জন, লাগসই সমাধানের কৌশল নির্ধারণ। এই দায়িত্বপালনের একটা সুস্পষ্ট বিভাজন দরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মিলে এই সমন্বয়ের পদক্ষেপ নিতে পারে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, ‘বিদ্যমান কাঠামোয় মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি বা উদ্যোগ নেই। যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই জরুরি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এই সংকট সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ব্র্যাকের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে একটি সময় উপযোগী সমাধান বের করা সম্ভব। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্র্যাকের মত উন্নয়ন সহযোগীকে পাশে পেতে চায় পরিবেশ অধিদপ্তর।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. বদরুল আমিন বলেন, ‘কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বর্জ্য গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এগুলো আলাদা করা যাচ্ছে না। আমরা এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি যাতে গৃহস্থালি থেকেই এই বর্জ্য আলাদাভাবে সংগ্রহ করা যায়। অন্যদিকে হাসপাতালের বর্জ্যও সাধারণ বর্জ্যের সাথে চলে যাচ্ছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে হাসপাতাল বর্জ্য আলাদাভাবে হস্তান্তর করা হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা দরকার।’