‘বিনিয়োগ বাড়াতে ছোট বড় সব বিনিয়োগকারীকে গুরুত্ব দিতে হবে’
৬ অক্টোবর ২০২০ ০০:৩১
ঢাকা: দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড়— সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বিদেশিরা এই দেশে প্রথমে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি অনুকূলে মনে করলে তখন ধীরে ধীরে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ করে। কিন্তু আমাদের নজরটা সবসময় বড় বিনিয়োগকারীর দিকে থাকে। এই ধরনের প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড়— সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের সমান সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই কেবল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে।
সোমবার (৬ সেপ্টম্বর) সারাবাংলা ডটনেটের নিয়মিত আয়োজন ‘সারাবাংলা ফোকাস’ ভার্চুয়াল আলোচনায় যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। এ আয়োজনের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘দেশে বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি’। সারাবাংলা ডটনেটের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট এমএকে জিলানীর উপস্থাপনায় আলোচনায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং বাংলাদেশ জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার ওমর সাহাদাৎ।
আলোচনায় বিডা) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, একটি দেশে বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক নেতৃত্ব, ভালো অবকাঠামো, ইজ অব ডুইং বিজনেসসহ যেসব পরিবশে দরকার, বাংলাদেশে তার সবগুলো রয়েছে। গত ১০ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের ওপরে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, বাংলাদেশে সে ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। আমাদের পোর্ট ক্যাপাসিটি, বিমানবন্দরগুলোর ক্যাপাসিটি বাড়ানো হচ্ছে। আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর ছিল না, সেটাও হচ্ছে। দেশে বর্তমানে একাধিক বন্দর হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগি আসার জন্য যেসব সেক্টরে উন্নয়ন দরকার, সেগুলো সবই করা হয়েছে। ফলে এর সুফল শিগগিরই আসতে শুরু করবে। বিডা চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগের জন্য দেশে ১৫৪টি সার্ভিস রয়েছে। ৩৫টি সরকারি সংস্থা থেকে এই সার্ভিস দেওয়া হবে। এরই মধ্যে ২১টি সংস্থার সঙ্গে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) করা হয়েছে। ১৫৪টি সংস্থাকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা কঠিন হলেও সরকার সে কাজটি করতে যাচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ব্যবসা করার জন্য বিশ্বব্যাংক যেসব পয়েন্ট দিয়েছে, আমরা কেবল সেগুলো নিয়েই কাজ করছি, তা নয়। বরং আমরা এর বাইরেও বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করছি। আমাদের দেশে ৬০ শতাংশ বিনিয়োগ পূর্ণ বিনিয়োগ হচ্ছে। এটা আস্থারই ফল।
সিপিডি‘র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত এক দশকে আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার হয়েছে। ২০৩১ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অর্জন কষ্টসাধ্য হলেও অসসম্ভব না। এটা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসার জন্য যথেষ্ট।
তিনি বলেন, ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মানুষের আয় বাড়ছে। গড় আয় ২ হাজার ডলার হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামে বসবাসকারী জনগণের মাথাপিছু আয় গড়ে ৫ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি হওয়ার কথা। ফলে এই দুই শহরের ভোক্তরা একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের জনগণের সমতুল্য আয়-ব্যয় করে থাকেন। ফলে এটা বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্য একটা আকর্ষণীয় গন্তব্য। তারপরও বাংলাদেশে যে পরিমাণ দেশীয় বিনিয়োগ হয়েছে, সে তুলনায় বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। আমাদের একটা লক্ষ্যমাত্রা ছিল যে ২০২০-২১ সালে আমাদের ৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু দেখা গেছে ২০১৯ সালে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছি।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে নজর দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশীয় বিনিয়োগকারীরা, যাদের মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হয়েছে, তাদের একটি বড় অংশ বড় মাপের বিনিয়োগকারী। কিন্তু দেশে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা তেমন বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এই জাগায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নজর দিতে পারেন।
তিনি বলেন, বিদেশিরা প্রথমে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পরিস্থিতি দেখতে চায়। পরে পরিস্থিতি অনুকূল মনে করলে বিনিয়োগ ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ করে। কিন্তু আমাদের সবসময় বড় বিনিয়োগকারীর দিকে নজর থাকে। কিন্তু তা না করে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদেরও সমান সুযোগ দিতে হবে। কারণ একটি সাপ্লাই চেইনের মধ্যে যদি সব ধরনের বিনিয়োগকারী না থাকে তাহলে ব্যবসা সম্প্রসারণ কষ্টকর হয়ে যায়। এতে করে সাপ্লাই চেইন বন্ধ হয়ে যায় এবং বড় বিনিয়োগকারীদের প্রতি নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়।
সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ সেভাবে আসেনি জানিয়ে সিপিডি’র এই গবেষণা পরিচালক বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি অনুকূলে থাকলেও সে তুলনায় বিনিয়োগ বাড়ছে না। ২০১৮ সালে ভারতে সাড়ে ৪২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের স্থান। বাংলাদেশে বিদেশিরার বিনিয়োগের জন্য যতটা আগ্রহ প্রকাশ করা হয়, সে পরিমাণ বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত আসে না। বিনিয়োগের জন্য যে পরিমাণ রেজিস্ট্রেশন হয়, বিনিয়োগ হয় তার চার ভাগের একভাগ।
বাংলাদেশ জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার ওমর সাহাদাৎ বলেন, সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে— বাংলাদেশ নতুন বিনিয়োগের জন্য একটি সম্ভাবনাময় দেশ। ফলে সবকিছু মিলে বাংলাদেশ একটি বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান। ২০১৮ সালে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছিল। সেটা সম্ভব হয়েছিল জাপানের একটি টোবাকো কোম্পানি আকিজ টোবাকো কিনে নেওয়ার কারণে।
তিনি বলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়ে তুলনা করব ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার সঙ্গে। কিন্তু আমাদের দেশের তুলনায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায় ৬/৭ গুণ বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। আমাদের দেশে তা কেন হচ্ছে না, সেটা বের করতে হবে।
ওমর সাহাদাৎ বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিডার একটি অফিস থাকা দরকার। সেই অফিস থেকে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া বিদেশ থেকে চামড়া কিনে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করে তা রফতানি করলেও আমাদের বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া থাকার পরও আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছি না— বিষয়টিকে দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন ওমর।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বড় বিনিয়োগকারী বাংলাদেশ জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বিডা বিডা চেয়ারম্যান বিদেশি বিনিয়োগ বিদেশি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ব্যারিস্টার ওমর সাহাদাৎ মো. সিরাজুল ইসলাম সাপ্লাই চেইন সারাবাংলা ফোকাস সিপিডি গবেষণা পরিচালক