‘আড়াই ঘণ্টায় ১০ জন ধর্ষণ করেছিল, অভিযোগ তরুণীর’
৯ অক্টোবর ২০২০ ২০:৪৮
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীতে দলবেঁধে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে পুলিশ। আক্রান্ত তরুণীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, গভীর রাতে নির্জন সড়কে আড়াই ঘণ্টা সময়ের মধ্যে অন্তত ১০ জন মিলে তাকে ধর্ষণ করেছে। তবে আক্রান্ত তরুণী সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ পেয়ে এক নারী সহযোগী ও অভিযুক্ত সাত ধর্ষককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতার সাত জনের মধ্যে একজন পুলিশের সোর্সও আছেন।
বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) রাতে নগরীর চান্দগাঁও থানা এলাকায় এই দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানাতে শুক্রবার (৯ অক্টোবর) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে আসেন নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-উত্তর) বিজয় কুমার বসাক।
তিনি জানান, আনুমানিক ২২ বছর বয়সী তরুণী বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় তার গ্রামের বাড়ি থেকে চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজারে বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। রাত ১১টার দিকে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় অটোরিকশা থেকে নেমে চকবাজারে যাওয়ার জন্য রিকশায় ওঠেন। এসময় সিএনজি অটোরিকশাযোগে অভিযুক্ত কয়েকজন ওই রিকশার পিছু নেয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চান্দগাঁও মৌলভী পুকুর পাড় এলাকায় জনৈক আনোয়ার সাহেবের চতুর্থ তলা ভবনের ডান পাশের গলিতে নিয়ে অন্তত ১০ জন মিলে তাকে ধর্ষণ করে। তাদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে ভোর ৪টার দিকে তরুণী নিজেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে যান। হাসপাতাল থেকে খবর পেয়ে চান্দগাঁও থানা পুলিশ সেখানে গিয়ে আক্রান্ত তরুণীর অভিযোগ নেন।
তরুণীকে তুলে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ, গ্রেফতার ৮
এরপর অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে পুলিশ। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে (৩৮) গ্রেফতার করে। বাকি সাত জনকে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হল- মো. ইউসুফ (৩২), মো. রিপন (২৭), মো. সুজন (২৪), দেবু বড়ুয়া (৩১), মো. শাহেদ (২৪), রিটু দত্ত (৩০) এবং মনোয়ারা বেগম (৫৫)। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর, ইউসুফ, দেবু ও রিটু অটোরিকশা চালক। রিপন ও সুজন বখাটে এবং মনোয়ারা বেগম গৃহিণী বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের উপকমিশনার বিজয় কুমার বসাক বলেন, ‘মনোয়ারা ও জাহাঙ্গীর মিলে মেয়েটিকে ফুসলিয়ে নিয়ে যায়। গলিতে নিয়ে একের পর এক তাকে ধর্ষণ করে। তরুণীর বক্তব্যমতে আমরা ৮ থেকে ১০ জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। রাত দেড়টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত তারা মেয়েটিকে আটকে এই ঘটনা ঘটায়। সাত জনকে গ্রেফতার করেছি। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আক্রান্ত তরুণী নিজেই ওসিসিতে যান। সেখান থেকে খবর পেয়ে আমরা ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলে গ্রেফতার অভিযানে নামি।’
১০ জন মিলে ধর্ষণের পর তরুণীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মেয়েটি এখন খুবই অসুস্থ অবস্থায় আছেন। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন। আমরা তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আড়াই ঘণ্টায় ১০ জন মিলে ধর্ষণের অভিযোগ তরুণীর। আমার প্রাথমিক তদন্তে একাধিক ব্যক্তির ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। তবে কতজন মিলে ধর্ষণ করেছে, সেটা পূর্ণাঙ্গ তদন্তে আসবে।’
তিনি আরও জানান, ধর্ষণের আগে তরুণীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তার কাছ থেকে মোবাইল ও দুই হাজার টাকা কেড়ে নেওয়া হয়।
এদিকে উপ পুলিশ কমিশনারের কার্যালয় থেকে নগরীর চান্দগাঁও থানায় নেওয়ার সময় গাড়িতে বসা গ্রেফতার কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। মনোয়ারা বেগম জানান, তিনি মানবপাচার আইনের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন। তখন আক্রান্ত তরুণীও কারাগারে ছিলেন। সেখানে তাদের পরিচয় হয়। গতকাল (বৃহস্পতিবার) জাহাঙ্গীর তাকে ফোন করে মৌলভী পুকুর পাড়ে যেতে বলেন। জাহাঙ্গীর পুলিশের সোর্স হওয়ায় এলাকায় তার প্রচুর দাপট। জাহাঙ্গীরের ফোন পেয়ে সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে কয়েকজন মিলে ধর্ষণের কথা জানতে পারেন।
গ্রেফতার জাহাঙ্গীর পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করার কথা স্বীকার করেন। তিনি সারাবাংলার কাছে দাবি করেন, গ্রেফতার সাত জনসহ তারা আরও কয়েকজন মিলে মৌলভী পুকুর পাড়ে বসে চা খাচ্ছিলেন। পুলিশের আরেক সোর্স সুমন তাকে ফোন করে জানায়, মেয়েটির এক বন্ধু তার কাছ থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে দুই হাজার টাকা নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না। মেয়ে ও তার বন্ধুকে পাওয়া গেছে। একথা শুনে তারা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তারা দু’জনকে গলির ভেতরে ঢুকিয়ে মারধর করেন। মেয়েটির বন্ধুকে টাকার জন্য বেশি মারধর করা হয়।
জাহাঙ্গীরের দাবি, মেয়েটিকে তারা কেউ ধর্ষণ করেনি। সোর্স সুমন ষড়যন্ত্র করে তাদের ধরিয়ে দিয়েছে।
গাড়িতে বসে কাঁদছিলেন গ্রেফতার হওয়া সুজন বড়ুয়া। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি শুধু ওই মেয়েটির বন্ধুকে দু’টি চড় দিয়েছিলাম। আমি বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম। আমাকে পুলিশ ধরে এনে মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে।’
দেবু বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা ধর্ষণ করিনি। পুলিশের সোর্স জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আরেক সোর্স সুমনের সম্ভবত ঝামেলা আছে। এই দু’জন মিলে আমাদের ফাঁসিয়ে দিয়েছে। জাহাঙ্গীর আমাকে বলায় আমি সরল বিশ্বাসে সেখানে গিয়েছিলাম। ধর্ষণ করিনি। আমাদের ডিএনএ টেস্ট করা হোক। মনোয়ারা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত। তার সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ক আছে।’
অভিযুক্তদের এসব দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপ পুলিশ কমিশনার বিজয় কুমার বসাক বলেন, ‘এতটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে কখনোই আমরা এই ধরনের ঘটনায় জড়িত করতে পারি না। তারা ঘটনায় জড়িত ছিল বলেই গ্রেফতার করেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা অনেক তথ্য এখন দিতে পারছি না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিকদের সামনে পুরো বিষয়টি ক্লিয়ার করার চেষ্টা করব।’
পুলিশ সোর্স জাহাঙ্গীর ও সুমনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।
আক্রান্ত তরুণী নিজেই বাদি হয়ে চান্দগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রাজেস বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আক্রান্ত নারী বিবাহিত। জাহাঙ্গীর তার স্বামীর পূর্বপরিচিত। পূর্বপরিচয়ের সূত্রেই জাহাঙ্গীর ওই নারীকে গলির ভেতরে নিয়ে যান। যে গলিতে ঘটনা হয়েছে, সেখানে মনোয়ারা থাকেন। ঘটনায় জড়িতদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মনোয়ারা ধর্ষণের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহারা দেন।’
গ্রেফতার আট জনকে শনিবার আদালতে নেওয়া হবে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ পরিদর্শক রাজেস বড়ুয়া।