এস এম সুলতানের স্মৃতিময় বাড়ি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ
১১ অক্টোবর ২০২০ ০৮:১০
নড়াইল: প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবন, কৃষক আর কৃষিকাজ যার তুলির টানে খুঁজে পেয়েছিল ছন্দ। আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম, এবং প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙালির টিকে থাকা তার ছবিতে মূর্তমান। চিত্রশিল্পী ছাড়াও ছিলেন সুরের সাধক, বাঁশির সুরে মাতিয়ে তুলতেন চিত্রার তীর। ভালোবাসতেন জীবন, সবুজ আর প্রাণের প্রাচুর্য।
১৯৮২ সালে নড়াইল শহরের চিত্রা নদীর পাড়ে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন এই শিল্পী। বাড়ির চারপাশে ছিল নানারকম ফুল-ফলের গাছ, আর ছোট একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা। পাশেই নদীর তীরে ছিল একটি বড় নৌকা, যেটিতে শিশুদের নিয়ে নদীতে ভেসে ভেসে ছবি আঁকা শেখাতেন। আমৃত্যু সেখানেই ছিলেন। সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত সেই বসতবাড়ি আজ জরাজীর্ণ দশায়। ভেঙে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা। দেশ-বিদেশের শিল্পবোদ্ধা আর পর্যটকদের প্রিয় এই জায়গাটির সংস্কারের দাবি জানাচ্ছেন এলাকাবাসী।
বরেণ্য এই শিল্পীর নামে স্মৃতিসংগ্রহশালা ও শিশুস্বর্গ নির্মাণ, আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বেশ উন্নয়ন হয়েছে। তবে চিত্রা নদীর পাড়ে ‘সুলতান ঘাট’ নির্মাণ কাজ শুরুতেই থমকে আছে। আর বসতঘরটির অবস্থা খুবই করুণ। এই ঘরেই সংরক্ষিত আছে সুলতানের ব্যবহৃত খাটসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। বাড়ির কেয়ারটেকার জানালেন, ঘরটির ভগ্নদশার কারণে সেগুলোও নষ্টের উপক্রম।
সরেজমিনে দেখা যায়, এসএম সুলতান তার জীবদ্দশায় যে ঘরটিতে বসবাস করতেন, সেই একতলা পাঁকাঘরটির অবস্থা খুবই করুণ। প্রায় পাঁচ বছর ধরে খসে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা। সংগ্রহশালা দেখভালের দায়িত্বে যারা আছেন তাদের কয়েকজন জানান, এস এম সুলতানের বসতঘরটির ছাদ বেশ জরাজীর্ণ। ঘরের ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতেও ভয় লাগে। কখন পলেস্তারা খসে পড়ে, তার ঠিক নেই। দ্রুত সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ঘরের মধ্যে সুলতানের ব্যবহৃত খাট, পোশাক, দ্বিতল নৌকার নোঙরসহ স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু রয়েছে।
সুলতানপ্রেমীদের দাবি, এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটনবান্ধব করে তোলা হোক সুলতান স্মৃতিসংগ্রহশালা। শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐহিত্য বলে, ‘আমি সুলতান দাদুর এখানে (শিশুস্বর্গ) ছবি আঁকা শিখি। করোনার কারণে অনেকদিন ক্লাস বন্ধ। সংগ্রহশালায় এসে ফুল-পাখি দেখি। তবে নৌকায় চড়তে পারি না। আমি সুলতান দাদুর দুইতলা নৌকায় চিত্রা নদীতে ঘুরতে চাই। এখানে একটি শিশুপার্কও চাই।’
নারীনেত্রী নাসিমা রহমান পলি বলেন, ‘আমার কিশোরী বেলায় সুলতান কাকুর সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে। কয়লা দিয়ে তার কাছে ছবি আঁকা শিখেছি। প্রাণের টানে মাঝে-মধ্যে সুলতান সংগ্রহশালায় ছুটে আসি। গত ৫ অক্টোবর এখানে (সংগ্রহশালা) এসে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ, ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গের ঘাট নির্মাণ এখনো শুরু হয়নি। আশপাশে ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। বিশেষ করে সুলতানের ব্যবহৃত খাটসহ স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু নষ্ট হচ্ছে।’
এস এম সুলতানের চিঠি সংগ্রাহক রূপগঞ্জ বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী তাহিদুল ইসলাম সারজান জানান, ‘সুলতান বেঁচে থাকাকালীন দুঃখ-কষ্টের কথা তার (সারজান) সঙ্গেই বেশি ভাগাভাগি করতেন। অভাব-অনটনে সুলতানের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন তিনি। সুলতানের লেখা এ সংক্রান্ত অনেক চিরকুট ও চিঠি সংগ্রহে রেখেছেন তিনি। এছাড়া তার দোকানে যে চেয়ারটিতে সুলতান প্রায়ই বসতেন, সেই চেয়ারটিও সেখানেই সংরক্ষিত আছে।’
এসব স্মৃতিচারণ করে সুলতানপ্রেমী তাহিদুল ইসলাম সারজান বলেন, ‘খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পীর বসতঘরটির জরাজীর্ণ দশার খবর শুনে খুবই মর্মাহত হলাম। এটি সুলতানের স্মৃতিবিজড়িত ঘর। আমাদের দাবি, দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে এসে যেন সুলতানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখার সুযোগ পান। সবকিছু যেন সুন্দর-পরিপাটি করা হয়।’
এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য সিনিয়র সাংবাদিক সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতান (এস এম সুলতান) শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের টানে, প্রকৃতি প্রেমে মুগ্ধ সুলতান দ্বিতল নৌকা গড়ে নাম দেন ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ। সেই নৌকায় করে চিত্রা নদীতে শিশু-কিশোরদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার মৃত্যুর পর নৌকাটি চিত্রা নদীর পাড়ে তুলে রাখা হয়েছে। নৌকাটি সুরক্ষিত ও দৃষ্টিনন্দন করতে ‘সুলতান ঘাট’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা থমকে আছে। দ্রুত ঘাট নির্মাণসহ এলাকাটি পর্যটনবান্ধব করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার মালি কাম গ্যালারি গার্ড গোলাপ কাজী বলেন, ‘এখানে প্রায় ১৭ বছর চাকরি করছি। করোনাকালীন প্রবেশ বন্ধ থাকলেও শীত মৌসুমসহ সারাবছরই এখানে দর্শনার্থী আসেন। দেশি-বিদেশি পর্যটক সুলতানের শিল্পকর্মের টানে এখানে ছুটে আসেন। তবে লোকবল সংকটসহ পর্যটন সুবিধা কম রয়েছে।’
সুলতান সংগ্রহশালার অফিস সহকারী চিত্রশিল্পী নয়ন বৈদ্য বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি সংগ্রহশালা খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বমানের সব চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। আমাদের প্রাণের দাবি, সংগ্রহশালাটি বিশ্বমানের করে গড়ে তোলা হোক।’
এসব প্রসঙ্গে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, ‘সুলতান সংগ্রশালাসহ ঘাটটিকে দৃষ্টিনন্দন ও পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে প্রায় দুই কোটি টাকা প্রয়োজন। অর্থ বরাদ্দ পেলে কাজগুলো শুরু হবে। এ ব্যাপারে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এস এম সুলতান। ১৯২৮ সালে ভর্তি হন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুলের অবসরে রাজমিস্ত্রি বাবাকে কাজে সহযোগিতা করতেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান। এ সময় ছবি আঁকার হাতেখড়ি তার। সুলতানের আঁকা সেইসব ছবি স্থানীয় জমিদারদের দৃষ্টি আর্কষণ হয়। এরপর নানা বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে খ্যতিমান চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠেন সুলতান।
গতকাল শনিবার (১০ অক্টোবর) ছিল বরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালের এই দিনে যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। জন্মভূমি নড়াইলের কুড়িগ্রামে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। স্থানীয়দের দাবি, খ্যাতিমান এই শিল্পীর বসতঘরসহ গোটা এলাকাকে তার আগামী জন্মদিনের আগেই যেন পরিপাটি রূপ দেওয়া হয়।