সিএনজিচালক থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী, যেভাবে গড়ে ওঠে দেলোয়ার বাহিনী
১০ অক্টোবর ২০২০ ২২:৫০
ঢাকা: ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে। টেনেটুনে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও টাকা উপার্জনের নেশায় প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। এটা-ওটা করতে করতে ২০১০-১১ সালের দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন ভাড়ায়। চার-পাঁচ বছর চালিয়েছেন সিএনজি। এর মধ্যেই সখ্য গড়ে ওঠে এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত ‘সুমন বাহিনী’র সদস্যদের সঙ্গে। একসময় সিএনজি চালানো বন্ধ করে দেন। ‘সুমন বাহিনী’র অংশ হয়ে রাতারাতি পাতি নেতা বনে যান। এলাকার ছোট-বড় নানা সমস্যা ‘মীমাংসা’ করে দিতে শুরু করেন। অস্ত্র আর অর্থের দাপটে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেন। এরপর নিজেই ৮-১০ জনকে নিয়ে শুরু করেন মাদক চোরাচালান।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নিপীড়নের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত কথিত সেই ‘দেলোয়ার বাহিনী’র গড়ে ওঠার ঘটনাক্রম মোটাদাগে এমনই। প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোনো সিএনজিচালক সেই দেলোয়ার হোসেনই এই বাহিনীর প্রধান।
বেগমগঞ্জের অধিবাসীরা বলছেন, অপরাধচক্রের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে ত্রাস ছড়ানো দেলোয়ারের বিরুদ্ধে তারা একাধিকবার অভিযোগ নিয়ে গেছেন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতারাও দেলোয়ারকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং কাজে লাগাতে শুরু করেন। রাজনৈতিক আনুকূল্য পেয়ে রীতিমতো ‘অপ্রতিরোধ্য’ হয়ে ওঠেন দেলোয়ার। মাদক কারবারের সঙ্গে সঙ্গে তাই চাঁদাবাজি, হুমকি-ধমকি, নারী নিপীড়ন হয়ে ওঠে তার নিত্যদিনের কাজ। এমনকি জোড়া খুনের এক মামলারও অন্যতম আসামি তিনি। সেই মামলায় জামিনে আছেন দেলোয়ার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন পদধারী নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ২০১৪ সালের দিকে দেলোয়ার কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে টাকা-পয়সা উপার্জন করে ওই ছেলেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ওই সময়কার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে দেলোয়ার। সে চেষ্টায় সফলও হয়। ওই নির্বাচনে স্থানীয় একলাশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী কৃষক লীগ সভাপতি আলমগীর কবির আলো তাকে নিজের কর্মীর স্বীকৃতি দেন। ওই নির্বাচনেই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরও তাকে নির্বাচনি প্রচারণায় ব্যবহার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একলাশপুর ইউনিয়নের স্থানীয় যুবলীগের একজন নেতা সারাবাংলাকে বলেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী আলমগীর কবির আলোর বিরুদ্ধে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় কেন্দ্র দখলের নেতৃত্ব দিয়েছে দেলোয়ার। ওই নির্বাচনে আলো চেয়ারম্যান হতে পারেননি। কিন্তু দেলোয়ারকে সবসময় নিজের বলয়ে রেখেছেন। তাই ২০১৮ সালের মার্চে একলাশপুর ও শরীফপুর গ্রামে জোড়া খুনের মামলায় দেলোয়ার আসামি থাকলেও আলো তার জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এরপর থেকেই কাথিত দেলোয়ার বাহিনীর তাণ্ডব বাড়তে থাকে।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, গত নির্বাচনে একলাশপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী কৃষক লীগ সভাপতি আলমগীর কবির আলো হচ্ছেন স্থানীয় বেগমগঞ্জ উপজেলার সংসদ সদস্য মো. মামুনুর রশিদ কিরণের আস্থাভাজন নেতা। আলমগীর কবির একসময় এমপি কিরণের মালিকানাধীন গ্লোব কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণার পর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন এমপি কিরণের। আবার সেই আলমগীর কবিরের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন দেলোয়ার। এ কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি কিরণের পক্ষে নির্বাচনি পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু এলাকায় নির্বাচনি প্রচারণাতেও দেলোয়ার সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করেন। ওই নির্বাচনে মামুনুর রশিদ কিরণ বিজয়ী হওয়ার পর দেলোয়ার নিজেকে ‘এমপির লোক’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন। নির্বাচনের পর দেলোয়ার ফুল দিয়ে এমপি কিরণকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন— এমন ছবিও ঘুরে বেড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
জাতীয় নির্বাচনে দেলোয়ারের পোস্টার ছাপানো বা নির্বাচনি প্রচারণায় দেলোয়ারের অংশগ্রহণ থাকলেও তাকে চেনেন না বলে দাবি করছেন সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচনের সময় হাজার হাজার মানুষ আমাকে ভালোবেসে আমার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সবাই-ই ছবি তুলেছে। তাদের বেশিরভাগকেই তো আমি চিনিও না। যারা সন্ত্রাসী বা নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত, তাদের কাউকে তো আমি কাছে ঘেঁষতে দেইনি। সেও যে আমার জন্য খেটেছে, তাও জানতাম না। সে একটি বাহিনীর প্রধান বা সন্ত্রাসী, এটা জানলে অবশ্যই তাকেও কাছে ঘেঁষতে দিতাম না।
এমপি কিরণ আরও বলেন, এখন চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর শুনতে পাচ্ছি সে নাকি আমার জন্য নির্বাচনের মাঠে ছিল। সুতরাং সে নির্বাচনের মাঠে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, তাকে আমি চিনেছি নারী নির্যাতনকারী হিসেবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি শুধু একটা কথাই বুঝি— এদের কাউকে ছাড় দেবো না। প্রশাসনকে বলেছি সবাইকে আইনের আওতায় আনতে।
এদিকে, দেলোয়ারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করলেন আলমগীর কবির আলো। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, দেলোয়ার বাহিনী বা দেলোয়ারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
দেলোয়ারের বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, দেলোয়ারের যে একটি বাহিনী রয়েছে, সেটি তাকে গ্রেফতারের পর সে স্বীকার করেছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে খুন ও মারামারির মামলা ছিল। বেগমগঞ্জের ঘটনার পর আবার মামলা হয়েছে।
গা ঢাকা দিয়েছে বেগমগঞ্জের ‘সম্রাট–সুমন’ বাহিনী
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কথিত দেলোয়ার বাহিনী সাম্প্রতি বেগমগঞ্জে প্রভাব বিস্তার করলেও ওই এলাকায় এই বাহিনীকে বলা যায় কনিষ্ঠ বাহিনী। বেগমগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়নে, পাড়ায় পাড়ায় নামে বেনামে সক্রিয় রয়েছে আরও ৩০টির মতো বাহিনী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— মন্নান বাহিনী, মুন্সি বাহিনী, জিকু বাহিনী, কামাল বাহিনী, বাঘা মিন্টু বাহিনী, মাসুম বাহিনী, পিচ্চি রাসেল বাহিনী, মুজিদ বাহিনী, হাছান বাহিনী, রকি বাহিনী, দুলাল বাহিনী, পাটোয়ারী বাহিনী, দেলোয়ার বাহিনী, জনি বাহিনী, মঞ্জু বাহিনী, সেন্টু বাহিনী ও বাবু বাহিনী। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কোনো না কোনো নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এসব বাহিনীর বাড়-বাড়ন্ত। আবার এসব বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ৩৬ মামলার আসামি খালাসী সুমনের নেতৃত্বাধীন সুমন বাহিনী ও ৩৮ মামলার আসামি সম্রাট বাহিনী। এসব বাহিনী থেকেই গড়ে ওঠা ছোট বাহিনীগুলোর একটি বাহিনীর নাম দেলোয়ার বাহিনী। স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনেও এসব বাহিনীর বেশ ‘কদর’ রয়েছে। আর সেই ‘কদরে’র কারণেই তাদের আশ্রয়ও দিতে হয়।
তবে বেগমগঞ্জে চাঞ্চল্যকর নারী নির্যাতনের ঘটনার পর গা ঢাকা দিয়েছেন প্রভাবশালী এসব বাহিনীর সদস্যরা। আর স্থানীয়দের মুখে মুখে যেসব বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, সেসব তথ্যও ভুল দাবি করছেন প্রভাবশালী নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র আক্তার হোসেন ফয়সাল জানান, তিনি কোনো বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন না। যেসব বাহিনীর নাম উঠে এসেছে, আগে এদের নামও তিনি শোনেননি।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর এসপি আলমগীর হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ছোট কিংবা বড় যেকোনো সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রড় দুটি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান সম্রাট ও সুমন দু’জনই পলাতক রয়েছে। কিছুদিন আগে সুমন জামিয়ে বেরিয়েছিল। তবে এ ঘটনার পর তারা আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।
একই কথা বললেন র্যাব-১১-এর অধিনায়ক (নোয়াখালী-কুমিল্লা-নারায়ণগঞ্জ) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল আলম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, চাঞ্চল্যকর নারী নির্যাতনের ঘটনার পর যেসব বাহিনীর নাম উঠে আসছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দেলোয়ার দেলোয়ার বাহিনী দেলোয়ার হোসেন বেগমগঞ্জ রাজনৈতিক আশ্রয়