ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন ড. ইউনুছ আলী: আপিল বিভাগ
১১ অক্টোবর ২০২০ ২৩:২৬
ঢাকা: বিচার বিভাগ নিয়ে ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুছ আলী ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে বলে আপিল বিভাগ তাকে ভর্ৎসনা করেছেন। রোববার (১১ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি হয়। সিনিয়র আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন।
শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এই আইনজীবী (ইউনুস আলী আকন্দ) একজন হ্যাবিচুয়াল কনটেম্পনার (অভ্যাসগত আদালত অবমাননাকারী)। এর আগে উনি তিনবার এ ধরনের অপরাধ করলেও তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর কতবার তাকে ছেড়ে দেবো? উনি এবার যে কাজ করেছেন সেটা কি ক্ষমারযোগ্য? উনার যে বয়স (৬১ বছর) তাতে প্র্যাকটিস থেকে অবসর নেওয়ার সময় হয়েছে।’
শুনানিকালে আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোন কাজটি গোপনে হয়েছে আপনারাই বলুন? ১৫ বছর ধরে যেসব ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে আছে, তাদের জেল আপিল শুনছি। এসব আপিল কি আমরা গোপনে শুনছি? উভয়পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি নিয়েই জেল আপিলের রায় দেওয়া হচ্ছে। তাতে কেউ খালাস পাচ্ছেন, কারও সাজা বহাল থাকছে। এসব পুরনো মামলা শোনার ক্ষেত্রে সরকারের কি স্বার্থ থাকতে পারে? পুরনো মামলা শুনানি করতে গিয়ে কি বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে? আর করোনাকালে আমরাই ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করেছি। আদালতের নানা বিষয়ের সঙ্গে গর্ভনমেন্টকে টেনে আনা বা যোগসূত্র খোঁজা দুঃখজনক।’
আদালত অবমাননাকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে লিখিত আবেদন দেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, এক হজারের মত জনস্বার্থমূলক মামলা করেছেন। তিনি জনস্বার্থ মামলা করার ক্ষেত্রে একজন ‘পাইওনিয়ার’। সেইসঙ্গে তার ওই ক্ষমার আবেদনে ১০/১৫ জন সিনিয়র আইনজীবীর নাম উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলেছেন উনি তাদের এই মামলায় এনগেজ করেছেন। কিন্তু সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন তাদের সম্মতি না নিয়েই ক্ষমার আবেদনে তাদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
আবেদনে উল্লিখিত অন্যান্য তথ্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, এটা কি আদালতকে ধোঁকা দেওয়া নয়? এত মিথ্যা আপনি ঢাকবেন কী করে? একটি নয়, হাজারটি মিথ্যা বলেছেন। তখন ইউনুস আলী বলেন, ‘মাই লর্ড যে আবেদন দিয়েছি সেটা পরিবর্তন করে নতুন আবেদন দেবো।’
এ সময় বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘যে আবেদন দিয়েছেন সেটা এখন কোর্টের রেকর্ড। এটা মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা যাবে না।’
এদিকে শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘ওই আইনজীবী ফেসবুকে যেসব স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করেছে।’
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাসে কার বিচার চেয়েছেন বা কারা বিচার বিভাগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, সেটা বলুন।’ আইনজীবী বলেন, ‘আমি বিচারক বা বিচার বিভাগ কোনটিকেই বোঝায়নি। আমি তো ক্ষমা চেয়েছি। যেদিন এই স্ট্যাটাস দিয়েছি সেদিনই মুছে ফেলেছি।’
বিচারপতি হাসান ফয়েজ বলেন, ‘ওই স্ট্যাটাস দিয়ে সারাবিশ্বে আমাদের জুডিসিয়ারিকে হেয় করেছেন।’ আইনজীবী বলেন, ‘আমাকে তলব করার আগেই তা ডিলিট করেছি?’ তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিথ্যা বলার আর জায়গা পান না।’
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান বলছে ভার্চুয়াল কোর্ট করোনাকালে ১ লাখ ৪৭ হাজার জামিনের আবেদন শুনেছে। ৭২ হাজার আসামিকে জামিন দিয়েছে।’
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘করোনাকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক আমাকে বলেছিল বর্তমান অবস্থায় কোর্ট খোলা ঠিক হবে না। কোর্ট খুললে হাঙ্গামা করবে আইনজীবীরা। কিন্তু করোনাকালে বিশ্বের কোনো দেশে সম্পূর্ণ কোর্ট বন্ধ থাকেনি। আপনারা (আইনজীবী) বাধ্য করেছেন কোর্ট বন্ধ রাখতে। তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘করোনায় মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা কোর্ট বন্ধ রাখার কথা বলেছিলাম।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা যখন কোর্ট খুলে দিলেন তখন আইনজীবীরা চিঠি ও ফেসবুকে শতশত স্ট্যাটাস দিয়ে বিরোধিতা করতে লাগলো। এরপর আমরা বসে ভার্চুয়াল কোর্ট খোলার প্রস্তাব দেই।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তো সমস্যার মধ্যে আছি, কোর্ট খুললেও বিপদ, আবার না খুললেও বিপদ।’
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা ৫০ দিনের অবকাশকালীন ছুটি বাতিল করেছি। ছুটিগুলো এনজয় করতে পারতাম। কিন্তু তা আমরা করিনি।’
সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘কোর্ট খুলে দেওয়ার আগে আমরা সমিতি থেকে আইনজীবীদের লোনের ব্যবস্থা করেছি। এখন কোর্ট খুলে দেওয়ায় কারও মধ্যে কোনো হাহাকার নাই। তিনি বলেন, ‘আপনাদের উদ্যোগ নেওয়ার কারণে এফিডেভিট ও ফাইলিং শাখায় দীর্ঘদিন ধরে যে অব্যবস্থাপনা ছিল সেটা দূর হয়েছে। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’
দীর্ঘ শুনানি শেষে সোমবার (১২ অক্টোবর) রায়ের জন্য রেখে মামলাটি আজকের জন্য শেষ করেন।